০১:৩৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কেরু কোম্পানিতে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য : চলছে মদ চুরির মহোৎসব

চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনায় অবস্থিত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। অনিয়মই যেন এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন ব্রান্ডের ফরেন লিকারসহ (মদ) এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন মালামাল চুরি, গায়েব ও নানা ঘটনা ঘটছে।

এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ নামমাত্র তদন্ত কমিটি করে দোষীদের সাময়িক শাস্তি দিলেও কিছুদিন পর তারা আবার সেই কারবার করে বহাল তবিয়তে থেকে যায়। যারফলে তৈরীও হয়েছে সিন্ডিকেট। গত সরকারের আমলে যা মাত্রা ছাড়াই। তবে গণঅভুত্থানের পর অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরও থেমে নেই সেই সিন্ডিকেট।

আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে আবারও তারা সক্রিয়। এবার ডিস্টিলারি বিভাগের এক ইলেক্ট্রিসিয়ানের যন্ত্র রাখা বাক্সে (টুল বক্স) মিলল ৬ বোতল ফরেন লিকার ও দুটি খালি বোতল।

সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ডিস্টিলারি এরিয়ার পাম্প হাউজে নিকট থেকে এগুলো উদ্ধার হয়। বিষয়টি প্রথমে ধামাচাপা থাকলেও পরে জানাজানি হয়ে যায়। এরপর নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ।

জুন মাসেও ১৩ হাজার লিটার ডিএস স্পিরিট গায়েব হবার অভিযোগও এই ডিস্টিলারি বিভাগে উঠেছিলো। সেসময় তদন্ত কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া সর্বশেষ গত মে মাসে ১০৪ জন শ্রমিক-কর্মচারির স্থায়ী নিয়োগ নিয়েও অর্থ লেনদেনসহ নানা অভিযোগ উঠে। যা নিয়ে সাবেক এমডি মোশাররফ হোসেন ও শ্রমিক-কর্মচারি ইউনিয়নে সভাপতি সবুজ, সাধারণ সম্পাদক মাসুদসহ সাতজনের নামে মামলাও করেন এক ব্যক্তি।

আরও পড়ুন

জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর মধ্যে একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড। এটি একটি সমন্বিত কারখানা। এখানে চিনি, ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন ধরনের স্পিরিট ও দেশি-বিদেশি মদ উৎপাদন করা হয়। কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড কারখানার মূল পণ্য চিনি হলেও কোম্পানিকে বাঁচিয়ে রেখেছে ডিস্টিলারি পণ্য মদ। সেই লাভের খাত কেটে মঝে মধ্যেই ঘটে চুরির ঘটে কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে চোরাই মদসহ একের পর এক গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটলেও কেরু প্রশাসন চুরি ঠেকাতে অনেকটাই নির্বিকার বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বরও চুরির চেষ্টার সময় ধরা পড়ে ৬ বোতল ফরেন লিকার । তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই বলছেন আসন্ন দূর্গাপূজা উপলক্ষেও বিপুল পরিমানে মদ চুরির আশঙ্কা রয়েছে। কারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এই উৎসব ঘিরে কেরুর ফরেন লিকারের (মদ) চাহিদা থাকে দেশব্যাপী তুঙ্গে।

সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে এই কারাখানায় উৎপাদিত দেশি মদ ও বিলাতি মদসহ (ফরেন লিকার) একাধিক চালান ধরা পড়েছে। এমনকি বোতলভর্তি বিলাতি মদ, মদের বোতলের লেবেল ও খালি বোতল উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। গ্রেপ্তার হয়েছে কেরুর শ্রমিকও। শ্রমিক সংগঠনগুলোই মূলত বছরের পর বছর এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের সময় স্থানীয় চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এমপি আলী আজগর টগর ও তার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনছুর বাবুই এ সিন্ডিকেটগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে বেপরোয়া করে তোলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, এই কোম্পানি থেকে দেশের বিভিন্ন পণ্যাগারে দেশি মদ পরিবহনের সময় তা চুরি ও পাচারের অভিযোগে চালকসহ শ্রমিক গ্রেপ্তারের একাধিক ঘটনা যেমন আছে, তেমনি ডিস্টিলারি থেকে বিলাতি মদ চুরির ঘটনাও একেবারে কম নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, ডিস্টিলারি বিভাগের কর্মকর্তারা মিলে শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের যোগসাজশে সুযোগ বুঝে শ্রমিকদের দিয়ে এই চুরির ঘটনাগুলো ঘটাই। যেটা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বেশি হয়েছে।

তারা আরও বলেন, এসমস্ত ঘটনায় ফরেন লিকার বিভাগের ‘ম’ আদ্যক্ষরের এক কর্মকর্তা এখনো এ সমস্ত সিন্ডিকেট মেইনটেইন করে যাচ্ছে। তবে তারা পুরো নাম বলতে রাজী হননি।

এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (ডিস্টিলারি) রাজিবুল হাসান বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি ডিস্টিলারি বিভাগের কারখানার ভিতরে মো আব্বাস আলী নামের ইলেকট্রিক হেলপার তার টুল বক্সের ভিতর ৬ টি ফরেন লিকারের বোতল নিয়ে চুরির চেষ্টা করছে। তৎক্ষনাত আমি, আমাদের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইউসুফ আলী স্যারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সেই টুল বক্স ভেঙ্গে ৬টি ফরেন লিকার এবং দুটি খালি বোতল উদ্ধার করি। এরপর ওই কর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা।

তিনি আরও বলেন, পুরো ডিস্টিলারি বিভাগ সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা শতভাগ সতর্ক।

আরও পড়ুন

একটু তথ্য ঘেটে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- এর আগে গত ৩১ আগস্ট কেরুর প্রধান ফটক থেকে ১০০ লিটার দেশি মদসহ ট্রাকচালক সাইফুল ইসলাম ও তাঁর দুজন সহকারীকে দর্শনা থানা-পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এছাড়া গত ১৫ জুলাই দর্শনা থানা-পুলিশ রামনগর থেকে ৪০ লিটার দেশি মদসহ বাদল শেখ নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দর্শনা পৌর এলাকার আনোয়ারপুরে অভিযান চালিয়ে কেরুর তৈরি ৭৫০ মিলিলিটার পরিমাপের সাত বোতল বিলাতি মদসহ দুজনকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এছাড়া ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুরে ডিবির তল্লাশির মুখে পড়ে কেরুর একটি কাভার্ড ভ্যানে ১০ লিটার দেশি মদ পায় ডিবি। এই মদ ব্যারেল থেকে চুরি করা হয়েছিল বলেও সেসময় জানায় পুলিশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি চার বোতল বিলাতি মদসহ কেরুর পরিবহন বিভাগের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক রকি হোসেন নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে ধরা পড়েন। সে যাত্রায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেইনি কর্তৃপক্ষ। গত ১৩ আগস্ট রাতে ডিস্টিলারির গুদামের ভেন্টিলেটর দিয়ে ১৩ নম্বর ভ্যাটে (মদ রক্ষণাগার) পাইপ লাগিয়ে দেশি মদ চুরির চেষ্টা করে। নামমাত্র থানা পুলিশ করে তিনি তারপরও অদৃশ্য শক্তিতে পার পেয়ে যায়।

এই ব্যক্তি আরও বলেন, গত পনেরো বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এরকম চুরির ঘটনার শেষ নেই। কিছু ঘটনা সামনে এসেছে, তাই সবাই জেনেছে। কিন্তু অধিকাংশ চুরিই অধরা। আর এর পিছনে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সাংসদ সদস্য আলী আজগর টগর এবং তার ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনছুর বাবুসহ আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজনের মদদ থাকায় দিনের পর দিন রাষ্ট্রীয় সম্পদ তছরুপ করেছে এই সংঘবদ্ধ চোরচক্র।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, কোম্পানি থেকে পণ্যাগারগুলোতে দেশি মদ পাঠানোর সময় ব্যারেলের মুখে যে নিরাপত্তা সিল লাগানো হয়, গাড়িতে পরিবহনের সময় চালক ও সহকারীরা সেটি খুলে মদ বের করে নেন। এরপর আগে থেকে সংগ্রহ করা সিল লাগিয়ে দেন। মদ চুরি বন্ধে পণ্যাগার থেকে ফেরা পরিবহন কোম্পানির পক্ষ থেকে এর আগে তল্লাশি চালানো এবং চোরাই মদ উদ্ধার করা হলেও নানামুখী চাপে তা বন্ধ হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসানের সঙ্গে দেখা করতে তার কার্যালয়ে গেলে তিনি ছুটিতে থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে ডিস্টিলারি বিভাগের কারখানার ভিতরে মো. আব্বাস আলী নামের ইলেকট্রিক হেলপারের টুলবক্সে ৬ বোতল ফরেন লিকার পাওয়া গেছে। আমি খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যেয়ে দেখি তার টুল বক্স ভেঙে এগুলো উদ্ধার করি। আমরা তাৎক্ষনিকভাবে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করি। পরবর্তীতে অভিযোগ দায়ের করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে অন্যান্য কোনো বিষয়ে বক্তব্য দেননি তিনি।

অভিযোগের বিষয় অভিযুক্ত আব্বাস আলীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি মোবাইল ফোনেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া আব্বাস আলীকে অফিসেও পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কেরু অ্যান্ড কম্পানি চিনি উত্পাদন ছাড়াও রয়েছে ডিস্টিলারি, কৃষি খামার, পরীক্ষামূলক খামার ও জৈব সার। আর এখানে ৯টি ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ উৎপাদন করা হয়। সেগুলো হলো ইয়েলো লেবেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্র্যান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ কুরাকাও, জরিনা ভদকা, রোসা রাম ও ওল্ড রাম।

One thought on “কেরু কোম্পানিতে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য : চলছে মদ চুরির মহোৎসব

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

জনপ্রিয়

দর্শনা থানা পুলিশের অভিযানে ৬ কেজি গাজাসহ দুজন আটক

কেরু কোম্পানিতে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য : চলছে মদ চুরির মহোৎসব

প্রকাশের সময় : ১০:২১:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৪ অক্টোবর ২০২৪

চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনায় অবস্থিত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। অনিয়মই যেন এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন ব্রান্ডের ফরেন লিকারসহ (মদ) এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন মালামাল চুরি, গায়েব ও নানা ঘটনা ঘটছে।

এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ নামমাত্র তদন্ত কমিটি করে দোষীদের সাময়িক শাস্তি দিলেও কিছুদিন পর তারা আবার সেই কারবার করে বহাল তবিয়তে থেকে যায়। যারফলে তৈরীও হয়েছে সিন্ডিকেট। গত সরকারের আমলে যা মাত্রা ছাড়াই। তবে গণঅভুত্থানের পর অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরও থেমে নেই সেই সিন্ডিকেট।

আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে আবারও তারা সক্রিয়। এবার ডিস্টিলারি বিভাগের এক ইলেক্ট্রিসিয়ানের যন্ত্র রাখা বাক্সে (টুল বক্স) মিলল ৬ বোতল ফরেন লিকার ও দুটি খালি বোতল।

সোমবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ডিস্টিলারি এরিয়ার পাম্প হাউজে নিকট থেকে এগুলো উদ্ধার হয়। বিষয়টি প্রথমে ধামাচাপা থাকলেও পরে জানাজানি হয়ে যায়। এরপর নড়েচড়ে বসে কর্তৃপক্ষ।

জুন মাসেও ১৩ হাজার লিটার ডিএস স্পিরিট গায়েব হবার অভিযোগও এই ডিস্টিলারি বিভাগে উঠেছিলো। সেসময় তদন্ত কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া সর্বশেষ গত মে মাসে ১০৪ জন শ্রমিক-কর্মচারির স্থায়ী নিয়োগ নিয়েও অর্থ লেনদেনসহ নানা অভিযোগ উঠে। যা নিয়ে সাবেক এমডি মোশাররফ হোসেন ও শ্রমিক-কর্মচারি ইউনিয়নে সভাপতি সবুজ, সাধারণ সম্পাদক মাসুদসহ সাতজনের নামে মামলাও করেন এক ব্যক্তি।

আরও পড়ুন

জানা যায়, রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর মধ্যে একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড। এটি একটি সমন্বিত কারখানা। এখানে চিনি, ভিনেগার, হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন ধরনের স্পিরিট ও দেশি-বিদেশি মদ উৎপাদন করা হয়। কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড কারখানার মূল পণ্য চিনি হলেও কোম্পানিকে বাঁচিয়ে রেখেছে ডিস্টিলারি পণ্য মদ। সেই লাভের খাত কেটে মঝে মধ্যেই ঘটে চুরির ঘটে কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে চোরাই মদসহ একের পর এক গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটলেও কেরু প্রশাসন চুরি ঠেকাতে অনেকটাই নির্বিকার বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সর্বশেষ গত ৩০ সেপ্টেম্বরও চুরির চেষ্টার সময় ধরা পড়ে ৬ বোতল ফরেন লিকার । তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই বলছেন আসন্ন দূর্গাপূজা উপলক্ষেও বিপুল পরিমানে মদ চুরির আশঙ্কা রয়েছে। কারণ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় এই উৎসব ঘিরে কেরুর ফরেন লিকারের (মদ) চাহিদা থাকে দেশব্যাপী তুঙ্গে।

সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে এই কারাখানায় উৎপাদিত দেশি মদ ও বিলাতি মদসহ (ফরেন লিকার) একাধিক চালান ধরা পড়েছে। এমনকি বোতলভর্তি বিলাতি মদ, মদের বোতলের লেবেল ও খালি বোতল উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। গ্রেপ্তার হয়েছে কেরুর শ্রমিকও। শ্রমিক সংগঠনগুলোই মূলত বছরের পর বছর এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের সময় স্থানীয় চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এমপি আলী আজগর টগর ও তার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনছুর বাবুই এ সিন্ডিকেটগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে বেপরোয়া করে তোলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, এই কোম্পানি থেকে দেশের বিভিন্ন পণ্যাগারে দেশি মদ পরিবহনের সময় তা চুরি ও পাচারের অভিযোগে চালকসহ শ্রমিক গ্রেপ্তারের একাধিক ঘটনা যেমন আছে, তেমনি ডিস্টিলারি থেকে বিলাতি মদ চুরির ঘটনাও একেবারে কম নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, ডিস্টিলারি বিভাগের কর্মকর্তারা মিলে শ্রমিক ইউনিয়ন নেতাদের যোগসাজশে সুযোগ বুঝে শ্রমিকদের দিয়ে এই চুরির ঘটনাগুলো ঘটাই। যেটা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বেশি হয়েছে।

তারা আরও বলেন, এসমস্ত ঘটনায় ফরেন লিকার বিভাগের ‘ম’ আদ্যক্ষরের এক কর্মকর্তা এখনো এ সমস্ত সিন্ডিকেট মেইনটেইন করে যাচ্ছে। তবে তারা পুরো নাম বলতে রাজী হননি।

এ বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক (ডিস্টিলারি) রাজিবুল হাসান বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি ডিস্টিলারি বিভাগের কারখানার ভিতরে মো আব্বাস আলী নামের ইলেকট্রিক হেলপার তার টুল বক্সের ভিতর ৬ টি ফরেন লিকারের বোতল নিয়ে চুরির চেষ্টা করছে। তৎক্ষনাত আমি, আমাদের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইউসুফ আলী স্যারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সেই টুল বক্স ভেঙ্গে ৬টি ফরেন লিকার এবং দুটি খালি বোতল উদ্ধার করি। এরপর ওই কর্মীকে সাময়িক বরখাস্ত করা।

তিনি আরও বলেন, পুরো ডিস্টিলারি বিভাগ সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। নিরাপত্তার বিষয়ে আমরা শতভাগ সতর্ক।

আরও পড়ুন

একটু তথ্য ঘেটে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- এর আগে গত ৩১ আগস্ট কেরুর প্রধান ফটক থেকে ১০০ লিটার দেশি মদসহ ট্রাকচালক সাইফুল ইসলাম ও তাঁর দুজন সহকারীকে দর্শনা থানা-পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এছাড়া গত ১৫ জুলাই দর্শনা থানা-পুলিশ রামনগর থেকে ৪০ লিটার দেশি মদসহ বাদল শেখ নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দর্শনা পৌর এলাকার আনোয়ারপুরে অভিযান চালিয়ে কেরুর তৈরি ৭৫০ মিলিলিটার পরিমাপের সাত বোতল বিলাতি মদসহ দুজনকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এছাড়া ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর রাতে চুয়াডাঙ্গার লোকনাথপুরে ডিবির তল্লাশির মুখে পড়ে কেরুর একটি কাভার্ড ভ্যানে ১০ লিটার দেশি মদ পায় ডিবি। এই মদ ব্যারেল থেকে চুরি করা হয়েছিল বলেও সেসময় জানায় পুলিশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি চার বোতল বিলাতি মদসহ কেরুর পরিবহন বিভাগের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক রকি হোসেন নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে ধরা পড়েন। সে যাত্রায় তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেইনি কর্তৃপক্ষ। গত ১৩ আগস্ট রাতে ডিস্টিলারির গুদামের ভেন্টিলেটর দিয়ে ১৩ নম্বর ভ্যাটে (মদ রক্ষণাগার) পাইপ লাগিয়ে দেশি মদ চুরির চেষ্টা করে। নামমাত্র থানা পুলিশ করে তিনি তারপরও অদৃশ্য শক্তিতে পার পেয়ে যায়।

এই ব্যক্তি আরও বলেন, গত পনেরো বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এরকম চুরির ঘটনার শেষ নেই। কিছু ঘটনা সামনে এসেছে, তাই সবাই জেনেছে। কিন্তু অধিকাংশ চুরিই অধরা। আর এর পিছনে চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সাবেক সাংসদ সদস্য আলী আজগর টগর এবং তার ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলী মুনছুর বাবুসহ আওয়ামী লীগের দলীয় লোকজনের মদদ থাকায় দিনের পর দিন রাষ্ট্রীয় সম্পদ তছরুপ করেছে এই সংঘবদ্ধ চোরচক্র।

অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, কোম্পানি থেকে পণ্যাগারগুলোতে দেশি মদ পাঠানোর সময় ব্যারেলের মুখে যে নিরাপত্তা সিল লাগানো হয়, গাড়িতে পরিবহনের সময় চালক ও সহকারীরা সেটি খুলে মদ বের করে নেন। এরপর আগে থেকে সংগ্রহ করা সিল লাগিয়ে দেন। মদ চুরি বন্ধে পণ্যাগার থেকে ফেরা পরিবহন কোম্পানির পক্ষ থেকে এর আগে তল্লাশি চালানো এবং চোরাই মদ উদ্ধার করা হলেও নানামুখী চাপে তা বন্ধ হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসানের সঙ্গে দেখা করতে তার কার্যালয়ে গেলে তিনি ছুটিতে থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বলেন, ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে ডিস্টিলারি বিভাগের কারখানার ভিতরে মো. আব্বাস আলী নামের ইলেকট্রিক হেলপারের টুলবক্সে ৬ বোতল ফরেন লিকার পাওয়া গেছে। আমি খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যেয়ে দেখি তার টুল বক্স ভেঙে এগুলো উদ্ধার করি। আমরা তাৎক্ষনিকভাবে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করি। পরবর্তীতে অভিযোগ দায়ের করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে অন্যান্য কোনো বিষয়ে বক্তব্য দেননি তিনি।

অভিযোগের বিষয় অভিযুক্ত আব্বাস আলীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি মোবাইল ফোনেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া আব্বাস আলীকে অফিসেও পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত কেরু অ্যান্ড কম্পানি চিনি উত্পাদন ছাড়াও রয়েছে ডিস্টিলারি, কৃষি খামার, পরীক্ষামূলক খামার ও জৈব সার। আর এখানে ৯টি ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ উৎপাদন করা হয়। সেগুলো হলো ইয়েলো লেবেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্র্যান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ কুরাকাও, জরিনা ভদকা, রোসা রাম ও ওল্ড রাম।