আশরাফুল ইসলাম তখন মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। অভাবের তাড়নায় এক পোশাক দুই বছর ব্যবহারের ফলে কিছুটা হলুদ ও মরিচা ধরে গিয়েছিল। সেই কারণে ক্লাসরুমে গোটা শিক্ষার্থীদের সামনেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাকে চরম অপমানিত করেছিলেন। কান ধরে মলেও দিয়েছিলেন। একটি মাত্র ছেড়া জুতা পায়ে দিনের পর দিন ক্লাস করেছেন। এভাবেই নিজের সংগ্রামী জীবনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন চুয়াডাঙ্গার অনার্স সম্পন্ন করা আইসক্রিম বিক্রেতা আশরাফুল ইসলাম।
আশরাফুল ইসলাম (২৮)। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে অনার্স সম্পন্ন করেছেন। বাবা অসুস্থতার কারণে কর্ম করতে পারেন না। তাই পুরো সংসার এখন আশরাফুলের ঘাড়ে। একটি নয়, দুটি সংসারের দায়িত্ব এখন তার হাতে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি পেলেও অল্প বেতন হওয়ায় চাকরি ছেড়ে এখন আইসক্রিম বিক্রি করে বেড়ান তিনি।
আশরাফুল ইসলাম চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়নের দৌলতদিয়াড় গ্রামের সরদারপাড়ার আবুল কালামের ছেলে।
সংগ্রামী জীবনটা শুরু হয়েছিল এইসএসসি পরিক্ষার পর। কৃতিত্বের সাথে এইসএসসি পাশ করার পর বাবা আবুল কালাম জানালেন পড়াশোনা আর এরপরও আশরাফুল ইসলাম মনোবল হারাননি তিনি।
২০১১ সালে চুয়াডাঙ্গা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও চুয়াডাঙ্গা পৌর ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপরে ২০২২ সালে আলমডাঙ্গার এম. এস. জোহা কৃষি কলেজ থেকে অনার্স সম্পন্ন করেন। এরপর করোনাকালীন সময় হওয়ায় মাস্টার্সে ভর্তি হতে না পারলেও এখন প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন আশরাফুল ইসলাম।
সরজমিনে দেখা যায়, চুয়াডাঙ্গা শহর সহ আশপাশের এলাকায় একটি ব্যাটারিচালিত প্যাখিভ্যানযোগে ঘুরে ঘুরে আইসক্রিম বিক্রি করছেন আশরাফুল ইসলাম। বাড়িতেই নিজের হাতে বানানো আইসক্রিম সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করতে দেখা যায় তাকে।
আশরাফুল ইসলাম রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, অভাবের সংসারে বাবা যখন বললেন আর পড়াতে পারবেন না আমাকে। তখন মনোবল ও দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে প্রতিজ্ঞা করি আমি নিজেই কিছু একটা করে অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করব। সেই থেকে আমার সংগ্রামী জীবন শুরু হয়েছে। টিউশনি ও বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে অনার্স সম্পন্ন করেছি। মাস্টার্সের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।

আশরাফুল ইসলাম রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, একটা চাকরি পেয়েছিলাম। সেটা সামান্য বেতনের। যা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়ায় চাকরিটা ছাড়তে হয়েছে। আমার বাবা অসুস্থতার জন্য কোন কর্ম করতে পারেন না। তবে শরীর সুস্থ থাকলে কখনো আইসক্রিম, কখনো ছাতা মেরামতসহ বিভিন্ন কাজ করে উপার্জন করেন। আমার স্ত্রী, আমার দুই ভাই ও বাবা-মাকে আমি নিজেই দেখাশোনা করি। এক কথায় পরিবারের বড় ছেলে হয়ে আমিই সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করছি। ছোট ও মেজো ভাই মাধ্যমিকের ছাত্র। বোনকে বিয়ে দিয়েছি। দুই ভাইয়ের পড়াশোনার সব খরচ বহন করছি। বাবা যতটুকু পারে তাই দিয়েই কোন মতে চলে যাচ্ছে আমাদের সংসার। মাস্টার্স ভর্তির প্রস্তুতি পাশাপাশি একটা ভালো চাকরির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, যে ভ্যানে করে আইসক্রিম বিক্রি করে সেটাও ভাড়া নেয়া। ভ্যানের জন্য প্রতিদিন দেড়’শ টাকা ভাড়া দিতে হয় মালিককে। আবার বৃষ্টির দিনে তেমন আইসক্রিম বিক্রি হয়না৷ আবার শীতের সময়ও। এই সময়টা ভ্যান চালিয়ে উপার্জন করতে হয়। এতে কোন রকম চলে যায়।
একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে আইসক্রিম বিক্রি করার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, কোন কাজই ছোট নয়। আমি কখনো লজ্জাবোধ করিনা। আল্লাহপাক যেখানে যার রিজিক লিখে রেখেছেন সেটার মাধ্যমেই রিজিক হবে। আবার অনেকেই আমাকে কটুক্তিও করেন। কিছুটা লজ্জা ও অপামানিতবোধ মনে হলেও বিষয়টি মানিয়ে নিই।
আশরাফুল ইসলামের বাবা আবুল কালাম রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, আমার বয়স হয়েছে। কাজ তেমন করতে পারিনা। শরীর ভাল থাকলে মাঝেমধ্যে আইসক্রিম বিক্রিসহ বিভিন্ন কাজ করে উপার্জন করি। আমার বড় ছেলেই সব দেখাশোনা করে।
তিনি আরও বলেন, অভাবের তাড়নায় ছেলেকে পড়াতে পারছিলাম না। সে নিজের মনোবল রেখে টিউশনি করে অনার্স পাশ করেছে। এতে আমি গর্বিত। এখন ছেলে একটা ভালো চাকরি পায় এই দোয়া করি।
আলুকদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নং ওয়ার্ডের (ইউপি) সদস্য তোশারেফ হোসেন রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, খুবই মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আশরাফুল ইসলাম। অনার্স পাশ করেও চাকরি না পেয়ে এখন আইসক্রিম বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছে। পাশাপাশি বাবাও আইসক্রিম বিক্রি, ছাতা মেরামত সহ বিভিন্ন কাজ করে সংসারের হাল ধরে রেখেছেন।
এএইচ