০৫:০০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের দাবিতে চুয়াডাঙ্গায় জনসংযোগ

‘জুলাই এর প্রেরণা, দিতে হবে ঘোষণা’ এই শ্লোগানে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের দাবিতে জনসংযোগ করেছে চুয়াডাঙ্গা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিবৃন্দ।

আজ মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) দিনব্যাপী চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে জনসংযোগ করেন তারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার উদ্যোগে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে জনআকাঙ্খার কথা নিয়ে আসতে এবং সকল শ্রেণির জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে ও রাষ্ট্রীয় সেবা সম্পর্কিত তাদের অভিমত জানতে এ কার্যক্রম পালন করা হয়।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা এবং জনসাধারণের সাথে ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সংক্রান্ত জনসংযোগ করেন তারা। এতে সাধারণ জনগণ রাষ্ট্রীয় সেবা সম্পর্কে তাদের মতামত তুলে ধরেন এবং জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র সম্পর্কে তাদের প্রত্যাশার বিষয়ে আলোচনা করেন।

ঘোষণাপত্রে বলা হয়, সংগ্রামী ছাত্র-জনতা, সবাইকে সালাম ও শুভেচ্ছাগত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণ একটি নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদী ও মাফিয়া শাসনের অধীনে চরম জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছিল।

রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ জনগণ ও শিক্ষার্থীদের জীবনে নেমে এসেছিল ঘোরতর এক বিপর্যয়। কর্মসংস্থান ছিল না, চাকরিতে ছিল দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতিসহ নানা দুর্নীতি, ছিল না কথা বলার অধিকারও। দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছে আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা।

গুম, খুন, ক্রসফায়ার, বিনা অপরাধে কারাগারে বন্দি, আলেম সমাজ ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর অমানবিক নির্যাতনের মতো ভয়াবহ সব মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল।

এ কাজে তারা রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কার্যত তিনটি নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল আওয়ামী অপশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা বারবার রাস্তায় নেমেছে।

গত জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারকে উৎখাত করেছে। স্বৈরাচারী হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কুখ্যাতি অর্জন করেন।

পালিয়ে যাওয়ার আগে দুই হাজারের মতো মানুষকে হত্যা, প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষের অঙ্গহানী করেছে খুনি হাসিনা ও তার দল।

গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে লাখো জনতার উপস্থিতিতে একদফা ঘোষণা করা হয়। সেখানে খুনি হাসিনার পতনের পাশাপাশি ছাত্র জনতা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপেরও অঙ্গীকার করে। এর সহজ অর্থ হচ্ছে, আর কোনো শাসক ক্ষমতায় গিয়ে যেন হাসিনার মতো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে সেরকম রাষ্ট্রব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

শহীদ মিনারে ঘোষিত এক দফার ভিত্তিতে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার উৎখাত হয়, যা সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।

এশিয়াসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে মুক্তিকামী জনগণের জন্য বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান এক নতুন দিশা ও প্রেরণা! দুনিয়ার যেখানেই মুক্তিকামী জনগোষ্ঠী স্বৈরাচার উৎখাত করেছে কিংবা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করেছে সেখানেই অভ্যুত্থানের শক্তি এ ধরনের ঐতিহাসিক অর্জনকে স্বীকৃতি দিতে জনগণের সামনে ঘোষণাপত্র তুলে ধরেছে।

ফরাসি বিপ্লব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আলজেরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিপ্লবী জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে আমরা এ ধরনের নজির দেখেছি।

নিপীড়িত ও মজলুম জনগোষ্ঠীর লড়াই হিসেবে আমরাও জনগণের সামনে এ ধরনের একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছি, যেন ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে সুরক্ষিত থাকে।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চেতনা ব্যবসার অবসান ঘটে। ফলে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আপামর জনগণের অর্জন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত এই অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানকে টিকিয়ে রাখতে এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে শুরু থেকেই আমরা একটি প্রোক্লেমেশন তথা ঘোষণাপত্র জারির দাবি জানিয়ে এসেছি।

এ ঘোষণাপত্রই হবে বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের বৈধতার উৎস এবং পরবর্তী সংবিধানের ভিত্তিমূল।

এই প্রেক্ষাপটে অন্তবর্তীকালীন সরকার গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সকল পক্ষের সঙ্গে কথা বলে একটি ঘোষণাপত্র জনগণের সামনে হাজির করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ফলে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ’ কর্মসূচির পরিবর্তে আমরা ‘মার্চ ফরইউনিটি’ আয়োজনের উদ্যোগ নিই। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষাধিক তরুণ ও জনতা সমাবেশে জড়ো হয়েছিল।

২০২৪ সাল পেরিয়ে যাওয়ার আগেই আমরা এ ঘোষণাপত্র দিতে চেয়েছি। জনগণের বিপুল সাড়া ও চাপের মুখে সরকার নিজে এ ঘোষণাপত্র জারির ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করতে বাধ্য হয়। আমরা অনতিবিলম্বে এ ঘোষণাপত্র জারির দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখতে চাই।

আপনারা জানেন, ইতিমধ্যে আমরা ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সরকারকে ১৫ দিনের মধ্যে ঘোষণাপত্র জনগণের সামনে তুলে ধরার সময় বেঁধে দিয়েছি। আমরা ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করার জন্য জোড়ালো দাবি জানাচ্ছি।

উক্ত ঘোষণাপত্রে এ জনগোষ্ঠীর বিগত দুইশত বছরের লড়াই-সংগ্রামের স্বীকৃতি থাকতে হবে। বিগত ১৬ বছরের জুলুম-নিপীড়ন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করাসহ অর্থ পাচারের খতিয়ান থাকতে হবে।

পরিশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ কীভাবে ভয়াবহ এই ফ্যাসিবাদী জিঞ্জির ছিন্ন করেছে তার উল্লেখ থাকতে হবে।

আমরা চাই অধিকার, ইনসাফ ও মর্যাদাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র। ব্যক্তি ও সমাজের সহাবস্থানে বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক এক রাষ্ট্রকল্প যেখানে ভোটাধিকারসহ সকল মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। বাহাত্তর-পচাত্তরের একদলীয় শাসন এবং এক-এগারোর বিরাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে গঠন করার সংকল্প ব্যক্ত করবে এই ঘোষণাপত্র।

ঘোষণাপত্রে বিষয়সমূহ হরো, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং আহতদের বিনামূল্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুচিকিৎসা প্রদানের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করতে হবে। ঘোষণাপত্রে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’এর নেতৃত্ব পরিস্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।

অভ্যুত্থানে আওয়ামী খুনী ও দোসরদের বিচার নিশ্চিত করার স্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যোগসূত্র রেখে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতা পরিস্কার করতে হবে।

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি সংবিধান বাতিল করে নির্বাচিত গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে সব ধরনের বৈষম্য নিরসনের মধ্যদিয়ে নাগরিক পরিচয় প্রধান করে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।

জুলাই অভ্যুত্থানের একমাত্র প্রধান লক্ষ্য আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারকে উৎখাত করা ছিল না, বরং গত ৫৩ বছরের বৈষম্য, শোষণ ও ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিলোপ করার লক্ষ্যে এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে।

সুতরাং বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো বিলোপ করতে সব ধরনের সংস্কারের ওয়াদা দিতে হবে।

জনসংযোগে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার আহ্বায়ক আসলাম হোসেন অর্ক, সদস্য সচিব সাফফাতুল ইসলাম, মুখ্য সংগঠক সজিবুল ইসলাম, মুখপাত্র তামান্না খাতুন, ফাহিম, রাকিব, কাফি, মাহিন, নিশাত, সৈকত, মারুফ, আকাশ, সুমন, সাকিব, নাহিদ, তামিম প্রমুখ।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

জনপ্রিয়

দর্শনা থানা পুলিশের অভিযানে ৬ কেজি গাজাসহ দুজন আটক

জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের দাবিতে চুয়াডাঙ্গায় জনসংযোগ

প্রকাশের সময় : ১১:২৬:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৫

‘জুলাই এর প্রেরণা, দিতে হবে ঘোষণা’ এই শ্লোগানে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের দাবিতে জনসংযোগ করেছে চুয়াডাঙ্গা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিবৃন্দ।

আজ মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) দিনব্যাপী চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে জনসংযোগ করেন তারা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার উদ্যোগে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে জনআকাঙ্খার কথা নিয়ে আসতে এবং সকল শ্রেণির জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে ও রাষ্ট্রীয় সেবা সম্পর্কিত তাদের অভিমত জানতে এ কার্যক্রম পালন করা হয়।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা এবং জনসাধারণের সাথে ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের মতবিনিময় সংক্রান্ত জনসংযোগ করেন তারা। এতে সাধারণ জনগণ রাষ্ট্রীয় সেবা সম্পর্কে তাদের মতামত তুলে ধরেন এবং জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র সম্পর্কে তাদের প্রত্যাশার বিষয়ে আলোচনা করেন।

ঘোষণাপত্রে বলা হয়, সংগ্রামী ছাত্র-জনতা, সবাইকে সালাম ও শুভেচ্ছাগত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের জনগণ একটি নজিরবিহীন ফ্যাসিবাদী ও মাফিয়া শাসনের অধীনে চরম জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকার জনগণের সকল অধিকার কেড়ে নিয়েছিল।

রাজনৈতিক দলসহ সাধারণ জনগণ ও শিক্ষার্থীদের জীবনে নেমে এসেছিল ঘোরতর এক বিপর্যয়। কর্মসংস্থান ছিল না, চাকরিতে ছিল দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতিসহ নানা দুর্নীতি, ছিল না কথা বলার অধিকারও। দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছে আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা।

গুম, খুন, ক্রসফায়ার, বিনা অপরাধে কারাগারে বন্দি, আলেম সমাজ ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপর অমানবিক নির্যাতনের মতো ভয়াবহ সব মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছিল।

এ কাজে তারা রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয়করণের মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করেছিল। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কার্যত তিনটি নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল আওয়ামী অপশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা বারবার রাস্তায় নেমেছে।

গত জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারকে উৎখাত করেছে। স্বৈরাচারী হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রীর কুখ্যাতি অর্জন করেন।

পালিয়ে যাওয়ার আগে দুই হাজারের মতো মানুষকে হত্যা, প্রায় অর্ধ লক্ষ মানুষের অঙ্গহানী করেছে খুনি হাসিনা ও তার দল।

গত ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে লাখো জনতার উপস্থিতিতে একদফা ঘোষণা করা হয়। সেখানে খুনি হাসিনার পতনের পাশাপাশি ছাত্র জনতা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপেরও অঙ্গীকার করে। এর সহজ অর্থ হচ্ছে, আর কোনো শাসক ক্ষমতায় গিয়ে যেন হাসিনার মতো ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে সেরকম রাষ্ট্রব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

শহীদ মিনারে ঘোষিত এক দফার ভিত্তিতে গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার উৎখাত হয়, যা সাম্প্রতিক বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।

এশিয়াসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে মুক্তিকামী জনগণের জন্য বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান এক নতুন দিশা ও প্রেরণা! দুনিয়ার যেখানেই মুক্তিকামী জনগোষ্ঠী স্বৈরাচার উৎখাত করেছে কিংবা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করেছে সেখানেই অভ্যুত্থানের শক্তি এ ধরনের ঐতিহাসিক অর্জনকে স্বীকৃতি দিতে জনগণের সামনে ঘোষণাপত্র তুলে ধরেছে।

ফরাসি বিপ্লব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আলজেরিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বিপ্লবী জনগোষ্ঠীর ইতিহাসে আমরা এ ধরনের নজির দেখেছি।

নিপীড়িত ও মজলুম জনগোষ্ঠীর লড়াই হিসেবে আমরাও জনগণের সামনে এ ধরনের একটি ঐতিহাসিক ঘোষণা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছি, যেন ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে দালিলিক প্রমাণ হিসেবে সুরক্ষিত থাকে।

স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চেতনা ব্যবসার অবসান ঘটে। ফলে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আপামর জনগণের অর্জন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত এই অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানকে টিকিয়ে রাখতে এবং বৈশ্বিক স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে শুরু থেকেই আমরা একটি প্রোক্লেমেশন তথা ঘোষণাপত্র জারির দাবি জানিয়ে এসেছি।

এ ঘোষণাপত্রই হবে বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের বৈধতার উৎস এবং পরবর্তী সংবিধানের ভিত্তিমূল।

এই প্রেক্ষাপটে অন্তবর্তীকালীন সরকার গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সকল পক্ষের সঙ্গে কথা বলে একটি ঘোষণাপত্র জনগণের সামনে হাজির করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ফলে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ’ কর্মসূচির পরিবর্তে আমরা ‘মার্চ ফরইউনিটি’ আয়োজনের উদ্যোগ নিই। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষাধিক তরুণ ও জনতা সমাবেশে জড়ো হয়েছিল।

২০২৪ সাল পেরিয়ে যাওয়ার আগেই আমরা এ ঘোষণাপত্র দিতে চেয়েছি। জনগণের বিপুল সাড়া ও চাপের মুখে সরকার নিজে এ ঘোষণাপত্র জারির ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করতে বাধ্য হয়। আমরা অনতিবিলম্বে এ ঘোষণাপত্র জারির দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখতে চাই।

আপনারা জানেন, ইতিমধ্যে আমরা ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সরকারকে ১৫ দিনের মধ্যে ঘোষণাপত্র জনগণের সামনে তুলে ধরার সময় বেঁধে দিয়েছি। আমরা ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘোষণাপত্রটি প্রকাশ করার জন্য জোড়ালো দাবি জানাচ্ছি।

উক্ত ঘোষণাপত্রে এ জনগোষ্ঠীর বিগত দুইশত বছরের লড়াই-সংগ্রামের স্বীকৃতি থাকতে হবে। বিগত ১৬ বছরের জুলুম-নিপীড়ন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করাসহ অর্থ পাচারের খতিয়ান থাকতে হবে।

পরিশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণ কীভাবে ভয়াবহ এই ফ্যাসিবাদী জিঞ্জির ছিন্ন করেছে তার উল্লেখ থাকতে হবে।

আমরা চাই অধিকার, ইনসাফ ও মর্যাদাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র। ব্যক্তি ও সমাজের সহাবস্থানে বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক এক রাষ্ট্রকল্প যেখানে ভোটাধিকারসহ সকল মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। বাহাত্তর-পচাত্তরের একদলীয় শাসন এবং এক-এগারোর বিরাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে গঠন করার সংকল্প ব্যক্ত করবে এই ঘোষণাপত্র।

ঘোষণাপত্রে বিষয়সমূহ হরো, জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং আহতদের বিনামূল্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে সুচিকিৎসা প্রদানের প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করতে হবে। ঘোষণাপত্রে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’এর নেতৃত্ব পরিস্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে।

অভ্যুত্থানে আওয়ামী খুনী ও দোসরদের বিচার নিশ্চিত করার স্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যোগসূত্র রেখে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতা পরিস্কার করতে হবে।

ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তি সংবিধান বাতিল করে নির্বাচিত গণপরিষদ গঠনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হবে। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে সব ধরনের বৈষম্য নিরসনের মধ্যদিয়ে নাগরিক পরিচয় প্রধান করে রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।

জুলাই অভ্যুত্থানের একমাত্র প্রধান লক্ষ্য আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারকে উৎখাত করা ছিল না, বরং গত ৫৩ বছরের বৈষম্য, শোষণ ও ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিলোপ করার লক্ষ্যে এ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে।

সুতরাং বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো বিলোপ করতে সব ধরনের সংস্কারের ওয়াদা দিতে হবে।

জনসংযোগে উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার আহ্বায়ক আসলাম হোসেন অর্ক, সদস্য সচিব সাফফাতুল ইসলাম, মুখ্য সংগঠক সজিবুল ইসলাম, মুখপাত্র তামান্না খাতুন, ফাহিম, রাকিব, কাফি, মাহিন, নিশাত, সৈকত, মারুফ, আকাশ, সুমন, সাকিব, নাহিদ, তামিম প্রমুখ।