০৪:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা-জীবননগর সীমান্ত যেন সোনার হাট–বাজার

১. দর্শনায় বিজিবির অভিযানে ২ মণ রুপার গয়না ও ২০টি স্বর্ণের বারসহ নারী আটক

২. ভারতে পাচারকালে কোটি টাকার সোনাসহ চোরাকারবারি আটক: ভারতে পাচারকালে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্তবর্তী ছয়ঘড়িয়া গ্রাম থেকে ১১টি সোনার বারসহ তাসলিমা খাতুন (২৫) নামের এক নারী আটক।

৩. ইজিবাইকে কোটি টাকার স্বর্ণ নিয়ে যাচ্ছিলেন নারী চোরাকারবারি: চুয়াডাঙ্গার দর্শনার সীমান্তবর্তী ছয়ঘড়িয়া গ্রাম থেকে আটক করা হয় সেই চোরাকারবারিকে।

৪. মোটরসাইকেল তল্লাশিতে বেরিয়ে এল ১৬ কোটি টাকার সোনা: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী রুদ্রনগর গ্রামে সোনা চোরাচালানকারী একজনকে আটক করেছে বিজিবি

৫. ভারতে পাচারকালে দর্শনা থেকে ৩ কেজি ১৬৩ গ্রাম সোনার বার উদ্ধার: চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০টি সোনার বার জব্দ করেছে বিজিবি

৬. চুয়াডাঙ্গায় কোটি টাকার স্বর্ণসহ নারী আটক: দর্শনা থানার অন্তর্ছয়ঘড়িয়া গ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান হবে এমন সংবাদের ভিত্তিতে রোববার অভিযান চালিয়ে ওই নারীকে আটক করা হয়।

৭. চুয়াডাঙ্গায় ৪৬টি স্বর্ণের বারসহ পাচারকারী আটক: চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ৪৬টি স্বর্ণের বারসহ এক পাচারকারীকে আটক করেছে বিজিবি।

৮. দর্শনা সীমান্ত থেকে ১০টি সোনার বারসহ আটক: চুয়াডাঙ্গা দামুরহুদা দর্শনা সীমান্ত থেকে ১০টি সোনার বারসহ ইমন আলী (২৮) নামের এক চোরাকারবারিকে আটক করেছে বিজিবি

৯. মাথাভাঙ্গা নদী থেকে ৬৮টি স্বর্ণের বারসহ একজনের লাশ উদ্ধার: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা সীমান্তে ৬৮টি স্বর্ণের বারসহ এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড

১০. চুয়াডাঙ্গায় ৬৮ স্বর্ণের বারসহ চোরাকারবারির লাশ উদ্ধার

গত কয়েক মাসে কিছু সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম এগুলো। এখানে বলা হয়েছে, শুধু ধরা পড়ার খবর, পাচার হয়েছে কত সোনা, এর কোনো হিসাব নেই। তবে পরিস্থিতি বোঝার জন্য বোধ করি এই শিরোনামগুলোই যথেষ্ট। কয়েকটি চাল টিপলেই গোটা হাঁড়ির অবস্থা বোঝা যায়।

শিরোনামগুলো পড়ে কিছুটা হতভম্ব, বিভ্রান্ত। এই এলাকার কে জড়িত নেই এর সঙ্গে? অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, নারী-পুরুষ, তরুণ-যুবক, বেকার—সবার সম্মিলিত প্রয়াসে চলে এই সোনা-রুপা-হীরা চোরাচালানের ব্যবসা। বড় ঘটনায় বড়দের নাম আসে, কিছুদিন তোলপাড় হয়, কেউ কেউ ধরা পড়ে কিন্তু চোরাই পথের ব্যবসা বন্ধ হয় না।

টেকনাফে নেশার বড়ি বিক্রি হয় প্রকাশ্যে। সেখানে নতুন কেউ বাড়ি করলেই স্থানীয় লোকজন বলেন ‘বাড়ি হচ্ছে ট্যাবলেট বিক্রির টাকায়।’ চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা-জীবননগর ও দামুড়হুদাতেও নাকি একই অবস্থা। এই সীমান্ত এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি বানালে, গাড়ি কিনলে বা নির্বাচনী রাজনীতিতে নামার জন্য টাকা ছড়ালে সবাই নাকি বলে এই টাকা সোনা চোরাচালানের টাকা। এলাকার কেউ যদি ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাড়ি তৈরি করেন, ব্যবসার শোরুম খোলেন বা সীমান্তের ওপারেও যদি পসার ঘটান—সবার একই মন্তব্য, এদের টাকার উৎস সোনা চোরাচালান। সবই ‘হয়তো’, কিন্তু কিছু সত্যতা যে আছে তা কি অস্বীকার করা যায়?

দেশের একটি বিশেষ এলাকা বিশেষ ব্যবসায় বিশেষায়িত হতেও দোষের কিছু নেই। যেমন রাজশাহীতে আম বা রেশমের ব্যবসা, কুষ্টিয়ায় বেঙ্গল গোটের ব্যবসা। কিন্তু যে বিষয়টি ভাবায়, তা হচ্ছে দেশের একটি বিশেষ সীমান্ত এলাকা কেন চোরাই সোনার হাটবাজার হয়ে উঠল? সেখানে কি সোনা–রুপার খনি আছে? সোনা-রুপা-হীরা আমদানি-রপ্তানির ‘হাব’ কি ওই এলাকা?

অসমর্থিত খবর: দেশে সোনা–রুপা–হীরার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বড় অংশই নাকি ওই এলাকা থেকে আসা। সৎ ব্যবসার সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই, কিন্তু এই ব্যবসার বড় অংশই অস্বচ্ছ—বলছেন এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাই। নৃশংসভাবে খুন হওয়া এমপি সাহেবের কলকাতার যে বন্ধুর বাড়ির খোঁজ পুলিশ দিয়েছে, সেই গোপাল বাবুও একজন জুয়েলারি ব্যবসায়ী, কিন্তু তাঁর কোনো শোরুম নেই। তাঁর আবাসিক বাড়িই তাঁর ব্যবসায়িক ঠিকানা। তিনি নাকি বাড়িতে বসেই এপার থেকে যাওয়া সোনার বিস্কুটের প্যাকেট ‘জায়গা মতো’ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসাই করেন। বড়ই তাজ্জব এই লেনা–দেনার এপার-ওপার ব্যবসা।

পত্রিকান্তরে জানা যাচ্ছে, দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের সোনা পাচারের অন্যতম রুট ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত। এই অঞ্চলের মাদক, সোনা, হুন্ডি ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক দুজন সংসদ সদস্য ও দুই বড় ব্যবসায়ী। অল্প দিনের ব্যবধানে তাঁরা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাঁরা একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে সোনার বার হিসেবে নিয়ে আসেন।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে ছাড় হওয়ার পর তাঁদের অর্ধশতাধিক কর্মী বাস ও ট্রেনযোগে ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা বর্ডার দিয়ে ভারতে পাচার করেন।

বিভিন্ন সময় বিজিবি ছোটখাটো চালান আটক করলেও বড় বড় চালান নিরাপদে পাচার হয়ে গেছে।

প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তা, পুলিশ ও ক্ষমতাধর সাংবাদিকদের অর্থ দিয়ে নির্বিঘ্নে এই ব্যবসা চলে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা এতই ক্ষমতাধর যে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেন না। মুখ খুললে হয় খুনের শিকার বা গুম হতে হয়। এসব খবর তো এখন সবার মুখে মুখে।

একটি বিশেষ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা চোরাচালানের এই ব্যাপকতা নিয়ে আন্তর্দেশীয় চোরাচালান চক্রের মুখোশ উন্মোচনে আন্তর্জাতিক মানের অনুসন্ধানী রিপোর্ট হয় না কেন? যে চিত্র ওপরে দেখলাম, আমাদের কোনো সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার তাড়না অনুভব করেন না কেন? হ্যাঁ, একটু পরিশ্রম হবে, এপারে–ওপারে যাতায়াতে অর্থও লাগবে। এই কাজ করার জন্য দেশে যোগ্য সাংবাদিক নেই, এমনটি আমি বিশ্বাস করি না।

আজকাল অর্থনীতির দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে আন্তমহাদেশীয় নানা অনুসন্ধান পৃথিবীজুড়ে হইচই ফেলে দিচ্ছে। সেখানে আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো পানের পিক ফেলা দূরত্বের সীমানার এপার-ওপার নিয়ে প্রতিবেদন করতে পারবে না বিশ্বাস করা মুশকিল। তবে হচ্ছে না কেন? সিনিয়র এক সাংবাদিক বন্ধু বলেন, দুই পারের চোরাচালান চক্রের নেটওয়ার্ক যত শক্তিশালী, পেশাদার সাংবাদিকদের নেটওয়ার্ক ততটাই দুর্বল। শুধু তা–ই নয়, চোরাচালানি চক্র মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকায় বা কলকাতায় বসেই।

সংবাদমাধ্যমের নানা সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই জানতে ইচ্ছে হয়, যাঁরা দেশের আনুষ্ঠানিক ব্যবসার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সোচ্চার, তাঁদের কেউ কি কখনো এই বিশেষ সীমান্ত এলাকার অস্বাভাবিক অনানুষ্ঠানিক ব্যবসা (ইনফরমাল ট্রেডিং) নিয়ে কোনো গবেষণা করেছেন? করে থাকলে জানা যেত, এই ব্যবসার আকারটি কত বড়, কত মানুষ এর সঙ্গে জড়িত?

কিন্তু ভেতরের খবর এই রকম: এই ইনফরমাল ব্যবসার জনক-জননীরা প্রভাবশালী সব মহলের সঙ্গেই ইনফরমাল সম্পর্ক রাখেন। কেউ কেউ সেই ইনফরমাল সম্পর্কের সুতা ধরেই ফরমাল প্রভাববলয়ে দৃশ্যমান হন। কেউ এমপি হন, কেউ হতে চান, কেউ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা হন, কেউ মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখেন।

চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা সীমান্তের সোনা বিছানো পথ আসল সোনার বাংলার স্বপ্নের বিপরীতমুখী। এই পথে হেঁটে আসল সোনার বাংলার পথে এগোনোই যাবে না। শুরুর শিরোনামগুলো সাক্ষ্য দেয়, এই সীমান্তপথ আসলে এমন এক ডোবাখানা, যেখানকার কচুরিপানা এপার–ওপার দুই পারেই বিস্তৃত। এই ডোবাখানা বন্ধ না হলে এই কচুরিপানার বিস্তৃতি ঠেকানো যাবে না।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

জনপ্রিয়

ভারতের স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা

চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা-জীবননগর সীমান্ত যেন সোনার হাট–বাজার

প্রকাশের সময় : ০১:৩৩:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১১ জুলাই ২০২৪

১. দর্শনায় বিজিবির অভিযানে ২ মণ রুপার গয়না ও ২০টি স্বর্ণের বারসহ নারী আটক

২. ভারতে পাচারকালে কোটি টাকার সোনাসহ চোরাকারবারি আটক: ভারতে পাচারকালে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্তবর্তী ছয়ঘড়িয়া গ্রাম থেকে ১১টি সোনার বারসহ তাসলিমা খাতুন (২৫) নামের এক নারী আটক।

৩. ইজিবাইকে কোটি টাকার স্বর্ণ নিয়ে যাচ্ছিলেন নারী চোরাকারবারি: চুয়াডাঙ্গার দর্শনার সীমান্তবর্তী ছয়ঘড়িয়া গ্রাম থেকে আটক করা হয় সেই চোরাকারবারিকে।

৪. মোটরসাইকেল তল্লাশিতে বেরিয়ে এল ১৬ কোটি টাকার সোনা: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী রুদ্রনগর গ্রামে সোনা চোরাচালানকারী একজনকে আটক করেছে বিজিবি

৫. ভারতে পাচারকালে দর্শনা থেকে ৩ কেজি ১৬৩ গ্রাম সোনার বার উদ্ধার: চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১০টি সোনার বার জব্দ করেছে বিজিবি

৬. চুয়াডাঙ্গায় কোটি টাকার স্বর্ণসহ নারী আটক: দর্শনা থানার অন্তর্ছয়ঘড়িয়া গ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান হবে এমন সংবাদের ভিত্তিতে রোববার অভিযান চালিয়ে ওই নারীকে আটক করা হয়।

৭. চুয়াডাঙ্গায় ৪৬টি স্বর্ণের বারসহ পাচারকারী আটক: চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ৪৬টি স্বর্ণের বারসহ এক পাচারকারীকে আটক করেছে বিজিবি।

৮. দর্শনা সীমান্ত থেকে ১০টি সোনার বারসহ আটক: চুয়াডাঙ্গা দামুরহুদা দর্শনা সীমান্ত থেকে ১০টি সোনার বারসহ ইমন আলী (২৮) নামের এক চোরাকারবারিকে আটক করেছে বিজিবি

৯. মাথাভাঙ্গা নদী থেকে ৬৮টি স্বর্ণের বারসহ একজনের লাশ উদ্ধার: চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা সীমান্তে ৬৮টি স্বর্ণের বারসহ এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে বর্ডার গার্ড

১০. চুয়াডাঙ্গায় ৬৮ স্বর্ণের বারসহ চোরাকারবারির লাশ উদ্ধার

গত কয়েক মাসে কিছু সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম এগুলো। এখানে বলা হয়েছে, শুধু ধরা পড়ার খবর, পাচার হয়েছে কত সোনা, এর কোনো হিসাব নেই। তবে পরিস্থিতি বোঝার জন্য বোধ করি এই শিরোনামগুলোই যথেষ্ট। কয়েকটি চাল টিপলেই গোটা হাঁড়ির অবস্থা বোঝা যায়।

শিরোনামগুলো পড়ে কিছুটা হতভম্ব, বিভ্রান্ত। এই এলাকার কে জড়িত নেই এর সঙ্গে? অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, নারী-পুরুষ, তরুণ-যুবক, বেকার—সবার সম্মিলিত প্রয়াসে চলে এই সোনা-রুপা-হীরা চোরাচালানের ব্যবসা। বড় ঘটনায় বড়দের নাম আসে, কিছুদিন তোলপাড় হয়, কেউ কেউ ধরা পড়ে কিন্তু চোরাই পথের ব্যবসা বন্ধ হয় না।

টেকনাফে নেশার বড়ি বিক্রি হয় প্রকাশ্যে। সেখানে নতুন কেউ বাড়ি করলেই স্থানীয় লোকজন বলেন ‘বাড়ি হচ্ছে ট্যাবলেট বিক্রির টাকায়।’ চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা-জীবননগর ও দামুড়হুদাতেও নাকি একই অবস্থা। এই সীমান্ত এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি বানালে, গাড়ি কিনলে বা নির্বাচনী রাজনীতিতে নামার জন্য টাকা ছড়ালে সবাই নাকি বলে এই টাকা সোনা চোরাচালানের টাকা। এলাকার কেউ যদি ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাড়ি তৈরি করেন, ব্যবসার শোরুম খোলেন বা সীমান্তের ওপারেও যদি পসার ঘটান—সবার একই মন্তব্য, এদের টাকার উৎস সোনা চোরাচালান। সবই ‘হয়তো’, কিন্তু কিছু সত্যতা যে আছে তা কি অস্বীকার করা যায়?

দেশের একটি বিশেষ এলাকা বিশেষ ব্যবসায় বিশেষায়িত হতেও দোষের কিছু নেই। যেমন রাজশাহীতে আম বা রেশমের ব্যবসা, কুষ্টিয়ায় বেঙ্গল গোটের ব্যবসা। কিন্তু যে বিষয়টি ভাবায়, তা হচ্ছে দেশের একটি বিশেষ সীমান্ত এলাকা কেন চোরাই সোনার হাটবাজার হয়ে উঠল? সেখানে কি সোনা–রুপার খনি আছে? সোনা-রুপা-হীরা আমদানি-রপ্তানির ‘হাব’ কি ওই এলাকা?

অসমর্থিত খবর: দেশে সোনা–রুপা–হীরার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বড় অংশই নাকি ওই এলাকা থেকে আসা। সৎ ব্যবসার সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই, কিন্তু এই ব্যবসার বড় অংশই অস্বচ্ছ—বলছেন এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাই। নৃশংসভাবে খুন হওয়া এমপি সাহেবের কলকাতার যে বন্ধুর বাড়ির খোঁজ পুলিশ দিয়েছে, সেই গোপাল বাবুও একজন জুয়েলারি ব্যবসায়ী, কিন্তু তাঁর কোনো শোরুম নেই। তাঁর আবাসিক বাড়িই তাঁর ব্যবসায়িক ঠিকানা। তিনি নাকি বাড়িতে বসেই এপার থেকে যাওয়া সোনার বিস্কুটের প্যাকেট ‘জায়গা মতো’ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসাই করেন। বড়ই তাজ্জব এই লেনা–দেনার এপার-ওপার ব্যবসা।

পত্রিকান্তরে জানা যাচ্ছে, দেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের সোনা পাচারের অন্যতম রুট ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত। এই অঞ্চলের মাদক, সোনা, হুন্ডি ও চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক দুজন সংসদ সদস্য ও দুই বড় ব্যবসায়ী। অল্প দিনের ব্যবধানে তাঁরা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাঁরা একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুবাই ও সিঙ্গাপুর থেকে সোনার বার হিসেবে নিয়ে আসেন।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেট বিমানবন্দর দিয়ে ছাড় হওয়ার পর তাঁদের অর্ধশতাধিক কর্মী বাস ও ট্রেনযোগে ঝিনাইদহের মহেশপুর ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা বর্ডার দিয়ে ভারতে পাচার করেন।

বিভিন্ন সময় বিজিবি ছোটখাটো চালান আটক করলেও বড় বড় চালান নিরাপদে পাচার হয়ে গেছে।

প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তা, পুলিশ ও ক্ষমতাধর সাংবাদিকদের অর্থ দিয়ে নির্বিঘ্নে এই ব্যবসা চলে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁরা এতই ক্ষমতাধর যে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করেন না। মুখ খুললে হয় খুনের শিকার বা গুম হতে হয়। এসব খবর তো এখন সবার মুখে মুখে।

একটি বিশেষ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা চোরাচালানের এই ব্যাপকতা নিয়ে আন্তর্দেশীয় চোরাচালান চক্রের মুখোশ উন্মোচনে আন্তর্জাতিক মানের অনুসন্ধানী রিপোর্ট হয় না কেন? যে চিত্র ওপরে দেখলাম, আমাদের কোনো সংবাদমাধ্যম এ নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করার তাড়না অনুভব করেন না কেন? হ্যাঁ, একটু পরিশ্রম হবে, এপারে–ওপারে যাতায়াতে অর্থও লাগবে। এই কাজ করার জন্য দেশে যোগ্য সাংবাদিক নেই, এমনটি আমি বিশ্বাস করি না।

আজকাল অর্থনীতির দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন নিয়ে আন্তমহাদেশীয় নানা অনুসন্ধান পৃথিবীজুড়ে হইচই ফেলে দিচ্ছে। সেখানে আমাদের সংবাদমাধ্যমগুলো পানের পিক ফেলা দূরত্বের সীমানার এপার-ওপার নিয়ে প্রতিবেদন করতে পারবে না বিশ্বাস করা মুশকিল। তবে হচ্ছে না কেন? সিনিয়র এক সাংবাদিক বন্ধু বলেন, দুই পারের চোরাচালান চক্রের নেটওয়ার্ক যত শক্তিশালী, পেশাদার সাংবাদিকদের নেটওয়ার্ক ততটাই দুর্বল। শুধু তা–ই নয়, চোরাচালানি চক্র মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকায় বা কলকাতায় বসেই।

সংবাদমাধ্যমের নানা সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই জানতে ইচ্ছে হয়, যাঁরা দেশের আনুষ্ঠানিক ব্যবসার নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সোচ্চার, তাঁদের কেউ কি কখনো এই বিশেষ সীমান্ত এলাকার অস্বাভাবিক অনানুষ্ঠানিক ব্যবসা (ইনফরমাল ট্রেডিং) নিয়ে কোনো গবেষণা করেছেন? করে থাকলে জানা যেত, এই ব্যবসার আকারটি কত বড়, কত মানুষ এর সঙ্গে জড়িত?

কিন্তু ভেতরের খবর এই রকম: এই ইনফরমাল ব্যবসার জনক-জননীরা প্রভাবশালী সব মহলের সঙ্গেই ইনফরমাল সম্পর্ক রাখেন। কেউ কেউ সেই ইনফরমাল সম্পর্কের সুতা ধরেই ফরমাল প্রভাববলয়ে দৃশ্যমান হন। কেউ এমপি হন, কেউ হতে চান, কেউ ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা হন, কেউ মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নও দেখেন।

চুয়াডাঙ্গা-দর্শনা সীমান্তের সোনা বিছানো পথ আসল সোনার বাংলার স্বপ্নের বিপরীতমুখী। এই পথে হেঁটে আসল সোনার বাংলার পথে এগোনোই যাবে না। শুরুর শিরোনামগুলো সাক্ষ্য দেয়, এই সীমান্তপথ আসলে এমন এক ডোবাখানা, যেখানকার কচুরিপানা এপার–ওপার দুই পারেই বিস্তৃত। এই ডোবাখানা বন্ধ না হলে এই কচুরিপানার বিস্তৃতি ঠেকানো যাবে না।