০৪:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

চোখের সামনে ‘ইতিহাস’ গড়েছিলেন যারা

গত বছরের জুলাই ও আগস্টে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ন্যায়ের প্রশ্নে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন ছিল রাষ্ট্রের রূঢ় বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চলছিল আন্দোলন। ঠিক তখনই ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে গুলি চালায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। প্রাণ হারায় অনেক তাজা প্রাণ। তারা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কেউ স্কুল কিংবা কলেজপড়ুয়া।

এই মৃত্যুগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা ছিল না। বরং এরা এক একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল— প্রতিবাদী, অদম্য, সাহসী ও ইতিহাসের প্রতীক। তরুণদের হত্যার প্রতিবাদে শহরের দেয়ালজুড়ে প্রতিবাদী গ্রাফিতি, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিদিনের ঝড়— সবমিলিয়ে গড়ে উঠেছিল এক গণআত্মস্মরণ। অনেক জায়গায় ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধ রুখে দিয়েছিল দমন-পীড়নের কৌশল।

আন্দোলনের সেই স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন শহর, শহর থেকে গ্রাম; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।

আজ সেই দিন— ৫ আগস্ট। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আত্মত্যাগ দেওয়া সেই সব তরুণকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছে জাতি। নিহত হওয়া অগণিত তরুণের মধ্যে এই পাঁচ তরুণের স্মৃতি আবারও তুলে ধরা হলো বিশেষ দিনটি উপলক্ষ্যে।

dhakapost

কোনো কোনো মৃত্যু কখনো কখনো জীবনের চেয়েও বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে। আবু সাঈদের মৃত্যু ঠিক তেমনই এক অধ্যায়। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলনের একজন সাংগঠনিক সমন্বয়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন। ১৬ জুলাই, দুপুর আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে ও লাঠিচার্জ করে। যখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এলাকা ত্যাগ করেন, তখন আবু সাঈদ একা দাঁড়িয়ে থাকেন হাতে একটি লাঠি নিয়ে। বুক চিতিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে।

তার এই দৃঢ় অবস্থান যেন হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নিঃশব্দ চিৎকার। খুব কাছ থেকে পুলিশ তার ওপর গুলি ছোড়ে। অবস্থান ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। কিন্তু তিনি তখনো সরে যাননি। একসময় গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহপাঠীরা দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই তরুণ।

আন্দোলনকারীরা আবু সাঈদকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে ঘোষণা করে। তার আত্মত্যাগ আন্দোলনের গতি পাল্টে দেয়, ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে প্রতিবাদের নতুন ঢেউ। আজও তার নাম উচ্চারিত হয় সাহসের প্রতীক হিসেবে, যে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রীয় শক্তির সামনে।

dhakapost

জমজ দুই ভাই, স্নিগ্ধ ও মুগ্ধ। আইডেন্টিকাল টুইন, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, একই মুখাবয়ব, একই স্বপ্নের আঁকাবাঁকা পথে হাঁটছিলেন দুজন। কিন্তু সেই পথ হঠাৎ থেমে যায় মীর মুগ্ধের জন্য। এক নির্মম গুলিতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই তরুণ। ভাই স্নিগ্ধ বেঁচে থাকলেও তার প্রতিচ্ছবি মুগ্ধ আর নেই।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র ছিলেন মুগ্ধ। আন্দোলনের সময়, মৃত্যুর ঠিক আগে, তিনি হাতে পানির বোতল নিয়ে আন্দোলনকারীদের মাঝে ঘুরে ঘুরে পানি দিচ্ছিলেন। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল এক মানবিক প্রশ্ন— ‘পানি লাগবে, পানি?’ এই একটি বাক্য, যা ধরা পড়েছিল ভিডিও ক্লিপে, আর তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। সেই শব্দ কাঁদিয়েছিল কোটি মানুষকে, ছুঁয়ে গিয়েছিল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে।

মুগ্ধ শুধু একজন শহীদ নন, হয়ে উঠেছেন আন্দোলনের এক মানবিক মুখ— যিনি মৃত্যুর আগমুহূর্তেও অন্যদের তৃষ্ণা নিবারণে ব্যস্ত ছিলেন।

dhakapost

‘One day you’ll leave this world behind. So live a life you will remember’— ফেসবুক প্রোফাইলে এই লাইনটি লিখেছিলেন ফারহান ফাইয়াজ। যেন নিজের ভবিতব্য আগেই জানতেন। রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এই শিক্ষার্থী কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিলে শামিল হয়েছিলেন মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু ফিরে আসেননি।

১৮ জুলাই বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের এবং সরকার দলীয় কর্মীদের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন ফারহান। বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তার তরুণ শরীর। আহত অবস্থায় তাকে মোহাম্মদপুর সিটি হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

ফারহানের মৃত্যু গোটা ছাত্রসমাজকে শোকাহত করে তোলে। তার ফেসবুকের ওই লাইন আজ আর শুধুই লেখা নয়, তা হয়ে উঠেছে একটি প্রজন্মের হৃদয়ে অমোচনীয় ছাপ।

dhakapost

সাভারের রাস্তায় পড়ে ছিল এক নিথর তরুণের দেহ। পুলিশি সাঁজোয়া যান থেকে টেনে ফেলে দেওয়া হয় তাকে। তারপর আবারও টেনে-হিঁচড়ে ফেলা হয় রাস্তার অপর পাশে। চরম নির্মমতার শিকার হন শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।

১৮ জুলাই সাভারের পাকিজা মডেল মসজিদের কাছে ঘটে ঘটনাটি। পুলিশি হামলায় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, আর ফিরে দাঁড়াতে পারেননি। বর্বরোচিতভাবে রাস্তায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এই তরুণকে। যিনি ছিলেন এমআইএসটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। থাকতেন ওসমানী হলে, বাড়ি ছিল সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায়।

বন্ধু ও পরিবারের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন simply ‘ইয়ামিন’ নামে। আজ তার নামটি শুধু এক তরুণ নয়, একটি বেদনার পতাকার মতো উড়ে চলে হাজারো প্রতিবাদী কণ্ঠে।

dhakapost

এক পাশে পতাকা মোড়ানো মাথা, অন্যপাশে ঝুলছে গুলিবিদ্ধ দুটো নিথর পা। রিকশায় করে কেউ নিয়ে যাচ্ছে এক তরুণের নিথর দেহ। সেই ছবি দেখে চোখের পানি আটকে রাখা ছিল অসম্ভব। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ভাইরাল হওয়া এই হৃদয়বিদারক ছবির তরুণটির নাম নাফিস। বয়স মাত্র ১৭। বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে সদ্য এসএসসি পাস করেছিলেন।

৪ আগস্ট সকালে শাহবাগ হয়ে ফার্মগেটের আন্দোলনে যোগ দেন নাফিস। দুপুর দেড়টায় মাকে কল দিয়ে জানান, তিনি নিরাপদে আছেন। মা তাকে দ্রুত ফিরে আসতে বলেন। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সন্ধ্যা পর্যন্ত খুঁজে না পেয়ে তার বাবা শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ছুটে বেড়ান, কিন্তু ছেলের কোনো খোঁজ মেলেনি।

রাত ১২টায় বাড়ি ফেরার পর ভাইরাল হওয়া সেই ছবিটি বড় ভাই দেখান বাবাকে। এরপর শুরু হয় মরদেহ শনাক্তের চেষ্টা। বহু জায়গায় খোঁজার পর নাফিসের মরদেহ পাওয়া যায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে।

নাফিসের মৃত্যু শুধু একটি প্রাণের অবসান ছিল না— সেটি ছিল সমগ্র জাতির হৃদয় ফাটা মুহূর্ত। এক কিশোর, যে ন্যায়ের স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল, গুলিবিদ্ধ হয়ে রয়ে গেল একটি ভাইরাল ছবির নিঃসাড় মুখ হয়ে।

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

জনপ্রিয়

চুয়াডাঙ্গায় পাঁচ দফা দাবিতে ইসলামী আন্দোলনের বি ক্ষো ভ সমাবেশ

চোখের সামনে ‘ইতিহাস’ গড়েছিলেন যারা

প্রকাশের সময় : ০১:১২:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ অগাস্ট ২০২৫

গত বছরের জুলাই ও আগস্টে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল ছাত্রদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ন্যায়ের প্রশ্নে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন ছিল রাষ্ট্রের রূঢ় বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব। শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চলছিল আন্দোলন। ঠিক তখনই ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে গুলি চালায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। প্রাণ হারায় অনেক তাজা প্রাণ। তারা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কেউ স্কুল কিংবা কলেজপড়ুয়া।

এই মৃত্যুগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা ছিল না। বরং এরা এক একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল— প্রতিবাদী, অদম্য, সাহসী ও ইতিহাসের প্রতীক। তরুণদের হত্যার প্রতিবাদে শহরের দেয়ালজুড়ে প্রতিবাদী গ্রাফিতি, সামাজিক মাধ্যমে প্রতিদিনের ঝড়— সবমিলিয়ে গড়ে উঠেছিল এক গণআত্মস্মরণ। অনেক জায়গায় ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধ রুখে দিয়েছিল দমন-পীড়নের কৌশল।

আন্দোলনের সেই স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন শহর, শহর থেকে গ্রাম; সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।

আজ সেই দিন— ৫ আগস্ট। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আত্মত্যাগ দেওয়া সেই সব তরুণকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছে জাতি। নিহত হওয়া অগণিত তরুণের মধ্যে এই পাঁচ তরুণের স্মৃতি আবারও তুলে ধরা হলো বিশেষ দিনটি উপলক্ষ্যে।

dhakapost

কোনো কোনো মৃত্যু কখনো কখনো জীবনের চেয়েও বেশি জীবন্ত হয়ে ওঠে। আবু সাঈদের মৃত্যু ঠিক তেমনই এক অধ্যায়। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এই আন্দোলনের একজন সাংগঠনিক সমন্বয়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিলেন। ১৬ জুলাই, দুপুর আড়াইটা থেকে তিনটার দিকে আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছোড়ে ও লাঠিচার্জ করে। যখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী এলাকা ত্যাগ করেন, তখন আবু সাঈদ একা দাঁড়িয়ে থাকেন হাতে একটি লাঠি নিয়ে। বুক চিতিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে।

তার এই দৃঢ় অবস্থান যেন হয়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নিঃশব্দ চিৎকার। খুব কাছ থেকে পুলিশ তার ওপর গুলি ছোড়ে। অবস্থান ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে। কিন্তু তিনি তখনো সরে যাননি। একসময় গুলিতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহপাঠীরা দ্রুত তাকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করলেও পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই তরুণ।

আন্দোলনকারীরা আবু সাঈদকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে ঘোষণা করে। তার আত্মত্যাগ আন্দোলনের গতি পাল্টে দেয়, ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে প্রতিবাদের নতুন ঢেউ। আজও তার নাম উচ্চারিত হয় সাহসের প্রতীক হিসেবে, যে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্রীয় শক্তির সামনে।

dhakapost

জমজ দুই ভাই, স্নিগ্ধ ও মুগ্ধ। আইডেন্টিকাল টুইন, একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, একই মুখাবয়ব, একই স্বপ্নের আঁকাবাঁকা পথে হাঁটছিলেন দুজন। কিন্তু সেই পথ হঠাৎ থেমে যায় মীর মুগ্ধের জন্য। এক নির্মম গুলিতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই তরুণ। ভাই স্নিগ্ধ বেঁচে থাকলেও তার প্রতিচ্ছবি মুগ্ধ আর নেই।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) ছাত্র ছিলেন মুগ্ধ। আন্দোলনের সময়, মৃত্যুর ঠিক আগে, তিনি হাতে পানির বোতল নিয়ে আন্দোলনকারীদের মাঝে ঘুরে ঘুরে পানি দিচ্ছিলেন। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল এক মানবিক প্রশ্ন— ‘পানি লাগবে, পানি?’ এই একটি বাক্য, যা ধরা পড়েছিল ভিডিও ক্লিপে, আর তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়। সেই শব্দ কাঁদিয়েছিল কোটি মানুষকে, ছুঁয়ে গিয়েছিল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বে।

মুগ্ধ শুধু একজন শহীদ নন, হয়ে উঠেছেন আন্দোলনের এক মানবিক মুখ— যিনি মৃত্যুর আগমুহূর্তেও অন্যদের তৃষ্ণা নিবারণে ব্যস্ত ছিলেন।

dhakapost

‘One day you’ll leave this world behind. So live a life you will remember’— ফেসবুক প্রোফাইলে এই লাইনটি লিখেছিলেন ফারহান ফাইয়াজ। যেন নিজের ভবিতব্য আগেই জানতেন। রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের এই শিক্ষার্থী কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিলে শামিল হয়েছিলেন মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু ফিরে আসেননি।

১৮ জুলাই বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের এবং সরকার দলীয় কর্মীদের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন ফারহান। বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তার তরুণ শরীর। আহত অবস্থায় তাকে মোহাম্মদপুর সিটি হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

ফারহানের মৃত্যু গোটা ছাত্রসমাজকে শোকাহত করে তোলে। তার ফেসবুকের ওই লাইন আজ আর শুধুই লেখা নয়, তা হয়ে উঠেছে একটি প্রজন্মের হৃদয়ে অমোচনীয় ছাপ।

dhakapost

সাভারের রাস্তায় পড়ে ছিল এক নিথর তরুণের দেহ। পুলিশি সাঁজোয়া যান থেকে টেনে ফেলে দেওয়া হয় তাকে। তারপর আবারও টেনে-হিঁচড়ে ফেলা হয় রাস্তার অপর পাশে। চরম নির্মমতার শিকার হন শাইখ আশহাবুল ইয়ামিন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।

১৮ জুলাই সাভারের পাকিজা মডেল মসজিদের কাছে ঘটে ঘটনাটি। পুলিশি হামলায় তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, আর ফিরে দাঁড়াতে পারেননি। বর্বরোচিতভাবে রাস্তায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এই তরুণকে। যিনি ছিলেন এমআইএসটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। থাকতেন ওসমানী হলে, বাড়ি ছিল সাভারের ব্যাংক টাউন আবাসিক এলাকায়।

বন্ধু ও পরিবারের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন simply ‘ইয়ামিন’ নামে। আজ তার নামটি শুধু এক তরুণ নয়, একটি বেদনার পতাকার মতো উড়ে চলে হাজারো প্রতিবাদী কণ্ঠে।

dhakapost

এক পাশে পতাকা মোড়ানো মাথা, অন্যপাশে ঝুলছে গুলিবিদ্ধ দুটো নিথর পা। রিকশায় করে কেউ নিয়ে যাচ্ছে এক তরুণের নিথর দেহ। সেই ছবি দেখে চোখের পানি আটকে রাখা ছিল অসম্ভব। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ভাইরাল হওয়া এই হৃদয়বিদারক ছবির তরুণটির নাম নাফিস। বয়স মাত্র ১৭। বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে সদ্য এসএসসি পাস করেছিলেন।

৪ আগস্ট সকালে শাহবাগ হয়ে ফার্মগেটের আন্দোলনে যোগ দেন নাফিস। দুপুর দেড়টায় মাকে কল দিয়ে জানান, তিনি নিরাপদে আছেন। মা তাকে দ্রুত ফিরে আসতে বলেন। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সন্ধ্যা পর্যন্ত খুঁজে না পেয়ে তার বাবা শাহবাগ থেকে ফার্মগেট, হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ছুটে বেড়ান, কিন্তু ছেলের কোনো খোঁজ মেলেনি।

রাত ১২টায় বাড়ি ফেরার পর ভাইরাল হওয়া সেই ছবিটি বড় ভাই দেখান বাবাকে। এরপর শুরু হয় মরদেহ শনাক্তের চেষ্টা। বহু জায়গায় খোঁজার পর নাফিসের মরদেহ পাওয়া যায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে।

নাফিসের মৃত্যু শুধু একটি প্রাণের অবসান ছিল না— সেটি ছিল সমগ্র জাতির হৃদয় ফাটা মুহূর্ত। এক কিশোর, যে ন্যায়ের স্বপ্ন দেখতে শিখেছিল, গুলিবিদ্ধ হয়ে রয়ে গেল একটি ভাইরাল ছবির নিঃসাড় মুখ হয়ে।