চুয়াডাঙ্গায় বঙ্গ পিভিসি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজের কারখানায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ কোটি ২৮ লাখ টাকা মূসক (ভ্যাট) ফাঁকির তথ্য উদ্ঘাটন করেছে যশোর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট।
প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত ওই অর্থ ফাঁকি দিয়েছে এমন অভিযোগ এনে কাস্টমস আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত ৯ জানুয়ারি এ মামলা করা হয়।
তবে বিপত্তি ঘটে তখনই, যখন অভিযান পরিচালনা করে ভ্যাট দায়েরের পরপরই মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয়। শুধু তাই নয়, কর্মচারীরা এ বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ ও সংবাদ সম্মেলন করে।
তাদের দাবি, কাস্টমস কর্মকর্তারা ঘুষ না পেয়ে ওই ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করেছে এবং মামলা দায়ের করেছে।
গত ৬ জানুয়ারি যশোর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট অফিসের অতিরিক্ত কমিশনার মো. রাকিবুল হসানের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের টিম অভিযান পরিচালনা করে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার মো. রাকিবুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গত ৬ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটিতে পরিদর্শনে যাওয়া হয়। ওই দিন খুবই স্বাভাবিক পরিবেশে নথিপত্র সংগ্রহ করা হয় এবং যাচাই-বাছাইয়ের পর ফাঁকির তথ্য উদঘাটিত হয়। এরপরই মামলা দায়ের করা হয়। এখানে ভিন্ন বিষয় নেই।
অন্যদিকে এ বিষয় মেসার্স বঙ্গ পিভিসি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক সেলিম আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, আমার কোনো নতুন বক্তব্য নেই। কর্মচারীদের বক্তব্যই আমার বক্তব্য। তবে এটুকু বলতে পারি, যে টাকার ভ্যাট দাবি করা হয়েছে, সেটা আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। সে কারণেই প্রতিষ্ঠান বদ্ধ ঘোষণা করেছি।
পণ্য বিক্রয়ের তথ্যের ওপরে ফাঁকির হিসাব করা হয়েছে তাহলে সমস্যা কোথায়, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভুল তথ্যের ওপর অ্যাসেসমেন্ট করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। আসলে আমার ছেলে একটি ঋণের আবেদন করেছিল। ওই ঋণের আবেদনের বিপরীতে যে ব্যাংকিং স্টেটমেন্ট দেওয়া হয়েছে, সেটা আমলে নিয়ে ভ্যাট ফাঁকির কথা বলছে তারা। আসলে ওটা পণ্য বিক্রয়ের তথ্য নয়।

এনবিআর ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ৬ জানুয়ারি চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলোকদিয়া গ্রামে অবস্থিত মেসার্স বঙ্গ পিভিসি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজে অভিযান পরিচালনা করা হয়। যশোর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট অফিসের অতিরিক্ত কমিশনার মো. রাকিবুল হসানের নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের টিম অভিযান পরিচালনা করে।
গত ৯ জানুয়ারি কাস্টমস আইনে ভ্যাট ফাঁকির মামলা দায়ের করা হয়। অভিযানকালে সেলস রিপোর্ট, বিদ্যুৎ বিল, অ্যাকাউন্ট রিসিভেবল শিট, রেজিস্টার খাতা, ফিজিক্যাল স্টক এবং কম্পিউটার সিপিইউ প্রভৃতি জব্দ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটির সঠিক কর নিরূপণের লক্ষ্যে জব্দকৃত দলিলপত্র যথাযথভাবে পর্যালোচনা করা হয়।
নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠান ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত আইভাস সিস্টেমে (ভ্যাট অনলাইন সিস্টেমে) দাখিলকৃত পত্রে প্রদর্শিত মোট বিক্রয়মূল্য ২ কোটি ৯০ লাখ ১৭ হাজার ৮৭৪ টাকা।
অপরপক্ষে অভিযানকালে প্রতিষ্ঠান থেকে জব্দকৃত বিক্রয় তথ্য অনুযায়ী বিক্রয়মূল্য ৪৪ কোটি ৭৩ লাখ ৬৭ হাজার ৯৮৩ টাকা উল্লেখ থাকলেও মাসভিত্তিক বিক্রয়মূল্যের যোগফল পাওয়া যায় ৪৩ কোটি ৩৯ লাখ ৬৭ হাজার ৯৮৩ টাকা, যা প্রতিষ্ঠানের উক্ত সময়ের প্রকৃত বিক্রয়মূল্য। বিক্রয়মূল্যকে ভিত্তি ধরে পরে হিসাব করা হয়। সেখানে দেখা যায়, ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত সময়ে দাখিলপত্রে প্রদর্শিত বিক্রয়মূল্য ২ কোটি ৯০ লাখ ১৭ হাজার ৮৭৪ টাকা।
অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ৪০ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার ১০৯ টাকা বিক্রয়মূল্য কম প্রদর্শন করা হয়েছে। যার মধ্যে মূসক আরোপযোগ্য বিক্রয়মূল্য হলো ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার ৫৩০ টাকা প্রযোজ্য। মূসক আরোপযোগ্য মূল্যের বিপরীতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হিসাব করলে ফাঁকিকৃত মূসক বা ভ্যাটের পরিমাণ ৫ কোটি ২৮ লাখ ১৯ হাজার ৫৭৯ টাকা যা প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে আদায়যোগ্য। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এর ধারা ৭৩ অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানের মোট ৫ কোটি ২৮ লাখ ১৯ হাজার ৫৭৯ টাকা রাজস্ব ফাঁকি উদঘাটন হয়েছে। যা সরকারের অনুকূলে আদায়যোগ্য বলে মনে করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
এদিকে মূসক (ভ্যাট) ফাঁকি উদঘাটনের দাবি আসলেও শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) চুয়াডাঙ্গায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরে সামনে এক বিক্ষোভ মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বঙ্গ পিভিসি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক হাফিজুর রহমান। এই সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক –কর্মচারী প্রতিনিধি আমিনুর ইসলাম ও টিপু সুলতান।
সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, গত সোমবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অতিরিক্ত কমিশনার রাকিবুল হাসান ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেনসহ ১২ সদস্যের একটি প্রিভেনটিভ দল ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আসেন। তল্লাশির নামে তাঁরা ডাকাতের মতো আচরণ করেন এবং সেলিম আহমেদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দাবি করেন। একপর্যায়ে অতিরিক্ত কমিশনার রাকিবুল হাসান সেলিম আহমেদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এবং তাঁকে (সেলিম আহমেদ) জোরপূর্বক অফিস কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে মূল্যবান কাগজপত্র তছনছ করেন। এ কারণে মালিকপক্ষ প্রতিষ্ঠানটি স্থায়ীভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে অভিযুক্ত এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট যশোরের অতিরিক্ত কমিশনার রাকিবুল হাসান ও তাঁর সহযোগী সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেনের শাস্তি, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিককে হয়রানি বন্ধ এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানটি চালুর দাবিতে শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তারা আন্দোলনে নেমেছে।
সংবাদ সম্মেলনের পর তাঁরা স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিল, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরে মানববন্ধন ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি পেশ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীরা দাবি করেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিককে হয়রানি বন্ধসহ বঙ্গ পিভিসি পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজ চালুর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে তাঁরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শনসহ কঠোর আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেন।
এএইচ