দিন শেষে মাঝেমধ্যে খালি পকেটেও বাড়ি ফিরতে হয়, এমন কথাই বললেন চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর রুটের লোকাল বাসচালক আরাফাত হোসেন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত স্টিয়ারিং হাতে রেখে রাস্তায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে চলেন তিনি। তারপরও সংসার চালানো তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। প্রতিদিন দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়, অসুস্থ হলেও বিশ্রামের সুযোগ নেই,না চালালে পেট চলে না। ধোঁয়া ও ধুলায় শ্বাসকষ্ট, চোখের সমস্যা, পিঠে ব্যথা, এসব তাদের নিত্যসঙ্গী। আবার এক মুহূর্তের ভুলে ঘটে যায় দুর্ঘটনা, কেউ পঙ্গু হন, কেউ হারান জীবন। তবুও চাকার ঘূর্ণন থামে না, কারণ সেটাই জীবিকার একমাত্র ভরসা।
আরাফাত হোসেন রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, এই পেশার সঙ্গে প্রায় ১৪ বছর ধরে আছি। হেলপার থেকে এখন ড্রাইভিং জগতে পা দিয়েছি। আমার বাবা একজন চালক ছিলেন। বাস চালকদের এখন এমন একটা করুন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। তেল কিনে গাড়ি চালিয়ে মালিকপক্ষের টাকা দেওয়াটাই অনেক কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনও দিন যাচ্ছে টিপ শেষ করে গাড়িতে তেল নিয়ে মহাজনদের টাকা দিতে পারছি না। মাঝেমধ্যে খালি পকেটে বাড়ি ফিরতে হয়। চুয়াডাঙ্গা-টু-মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা-টু-হাটবোয়ালিয়া রুটে গাড়ি চালাই। সকাল ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চালাই। দিনে ছয় সিঙ্গেল টিপ মেরে মোটে ৩০০০ টাকা পাই। তেল, রোড খরচ, চাঁদা আর মালিকের টাকা বাদ দিলে হাতে থাকে মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এতে সংসার চালানো কষ্টকর। চারজন সদস্য আমার উপর নির্ভরশীল। ধার করে কোনোভাবে চলতে হয়।”

তিনি আরও বলেন, রাস্তায় অবৈধ যান আর ইজিবাইকের কারণে আমাদের ভাড়া নাই। মাসে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকায় সংসার চলে না। সরকার যদি পরিবহন সেক্টরে একটু নজর দেয়, তাহলে আমরা বাঁচতে পারি। সকাল থেকে রাত অবধি গাড়ি চালিয়ে ঘরে ফিরি, সন্তানদের সময় দিতে পারি না। সমাজে ড্রাইভারদের ভালো চোখে দেখে না, অপমানও হতে হয়।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাস্তায় হাইওয়ে পুলিশ, সেনাবাহিনী, সবাই ড্রাইভারদের হেনস্তা করে। ড্রাইভারদের সম্মান নাই। অথচ এই ড্রাইভাররাই দিনরাত যাত্রী আর পণ্য নিরাপদে পৌঁছে দেয়। একসময় আমাদের ‘ড্রাইভার সাহেব’ বলা হতো, এখন সেই সম্মান হারিয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন, অনেক ড্রাইভার এই পেশা ছেড়ে অটো বা ভ্যান চালাচ্ছে, কারণ সম্মান নেই। ড্রাইভারদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো দেওয়া হয় না। দুর্ঘটনায় মারা গেলে পরিবারের পাশে কেউ আসে না। সরকার যদি ড্রাইভারদের জন্য ভাতা, বীমা ও সম্মানের ব্যবস্থা করত, তাহলে আমাদের কষ্ট কিছুটা কমত।

চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ১ আগস্ট পর্যন্ত জেলায় সড়কে নিহত হয়েছেন ৬২ জন, আহত হয়েছেন ৭০ জন। এরমধ্যে বেশিরভাগই অবৈধযানের সঙ্গে দূর্ঘটনা ঘটছে।
আরাফাতের মতোই একই কষ্টের কথা জানালেন চালজ মাহফুজ হোসেন। তিনি ছয় বছর ধরে এই পেশায় আছেন। তিনি রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, আমরা ২৪ ঘণ্টা দেশের মানুষের জন্য সেবা দিই, কিন্তু আমাদের জীবনে কোনো নিরাপত্তা নেই। নানা অজুহাতে পুলিশ মামলা দেয়, মালিকপক্ষ চাপ দেয়, সংগঠনের নেতারাও পাশে দাঁড়ায় না। শরীর খারাপ হলেও গাড়ি চালাতে হয়। হাত-মাজা ব্যথা, ঠান্ডা-জ্বর, অনিদ্রা সবই সহ্য করতে হয়।
তিনি বলেন, গরমের সময় এসিবিহীন গাড়ি চালানো অসহ্য হয়ে পড়ে। রাস্তার ধারের ধাবায় অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হয়। ধর্মঘট হলে সংসার চলে ধার করে। সংগঠন থেকেও তেমন সহযোগিতা পাই না। করোনা সময়ে অনেকেই অন্য কাজ করে টেনেছি। চালকদের বেতন এমন যে, সন্তানদের পড়াশোনা পর্যন্ত চালানো মুশকিল। তাই চাই না আমার সন্তান এই পেশায় আসুক।

চালক মাহফুজ রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, শেরপুরে একবার আমার গাড়ির হালকা ধাক্কায় স্থানীয়রা মারতে আসে, পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখেছে। আবার সাভারে আমার চোখের সামনে শাহ সিমেন্ট কোম্পানির এক ড্রাইভারকে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। ড্রাইভারদের জীবনে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই।
চুয়াডাঙ্গা-কুষ্টিয়া রুটের লেগুনা চালক মোহাম্মদ মাসুদ রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে পারভেজ জানান, আমি দুই বছর ধরে এই পেশায়। আমাদের গাড়ি চুয়াডাঙ্গা শহরের একাডেমির মোড় থেকে বড়বাজার হয়ে কার্পাসডাঙ্গা পর্যন্ত যায়। প্রতিদিন চার থেকে ছয় সিঙ্গেল টিপ মারি। মহাজনকে ৫০০-৭০০ টাকা দিয়ে যা থাকে, আল্লাহর রহমতে কোনোমতে সংসার চলে। চুয়াডাঙ্গার মধ্যেই চালাই বলে বড় সমস্যা হয় না, কিন্তু বাইরে গেলে ঝামেলা পোহাতে হয়।
তিনি বলেন, আমাদের রুটে আগে বাস চলত, এখন পিকআপ ভ্যান চলে। মালিক সমিতির অধীনে সব চলে, তারা বিপদে সহযোগিতা করে। তবে দীর্ঘ সময় স্টিয়ারিং হাতে রাখলে হাত ব্যথা হয়, খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রাম ঠিকমতো হয় না। রাস্তা ভাঙাচোরা থাকলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে।

চালক সবুজ রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, সকাল ৬ টা রাত ৮ পর্যন্ত আমি গাড়ি চালিয়ে থাকি। দিনে ছয় সিঙ্গেল টিপ ভাড়া মেরে থাকি। রোড খরচ, তেল খরচ, চাঁদা ও মালিকের টাকা দিয়ে আমাদের থাকে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এতে আমাদের সংসার চালানো খুব কষ্টকর। আমার পরিবারের চারজন সদস্য আমার উপর নির্ভরশীল। ২০০ থেকে ৩০০ টাকাই তো সংসার চলেই না। কারোর কাছ থেকে টাকা ধার নিলে এই মাসের টাকা সামনে মাসে দিতে হয়। মালিকদের জানালে তারা আমাদেরকে বলে আপনাদের না চললে গাড়ি চালিয়েন না। আমরা সকালবেলা বের হয়ে রাতে বাসায় যাই যার কারনে সন্তান সহ পরিবারের কাউকে সময় দিতে পারি না। আমরা কর্ম করে খাই তবুও সমাজের মানুষ ড্রাইভার হেলপারদেরকে ভালো চোখে দেখেনা। পেশার কারণে কখনো কখনো অপমান অপদস্ত হতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানোর কারনে আমাদের চোখে হাতে পায়ে সমস্যা সহ বিভিন্ন সমস্যা হয়। ঘুমের ভাব আসলে আমরা তখন গাড়ির সাইড করে রেখে একটু রেস্ট নিয়ে আবার গাড়ি চালাই। আমার লাইফে আমি কখনো অ্যাক্সিডেন্ট করি নাই। তবে আমি অনেকগুলো অ্যাক্সিডেন্ট নিজের চোখে দেখেছি। আমরা দীর্ঘ সময় পথে থাকার কারণে আমাদের খাওয়া ঠিক মত বা সময় মত হয় না। খনো হোটেলে আবার কখনো বাসা থেকে খাবার নিয়ে খেতে হয়। আমরা বাসায় ফিরে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা ঘুমাতে পারি। কখনো অসুস্থ হলে যতটুকু পারি নিজেরা চিকিৎসা করি, না পারলে মালিকপক্ষকে জানালে তারা যতোটুকু দেয় সেটুকু দিয়ে চিকিৎসা করি। তবে আমি ড্রাইভার পেশা নিয়ে গর্বিত।

চুয়াডাঙ্গা জেলা বাস-মিনিবাস, কোস্টার ও মাইক্রোবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এম. জেনারেল ইসলাম রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, আমি ৪৫ বছর ধরে এই সংগঠনে কাজ করছি। পরিবহন শ্রমিকরা সারাদিনরাত সেবা দেয়, কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। ঈদে পোশাক বা বোনাস পর্যন্ত মালিকরা দেয় না। রাস্তাঘাটের অবস্থা ভয়াবহ—স্পিড ব্রেকারে রং নেই, সাইনবোর্ড নাই—যার কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
তিনি বলেন, পরিবহন শ্রমিকরা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেবা দেন, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো স্বাস্থ্য ফান্ড, অবসরকালীন সুবিধা বা পরিবারের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ শ্রমিকদের জন্য ‘কালো আইন’। সরকারের উচিত শ্রমিকদের বেতন, চিকিৎসা ও অবসরের পর আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা। আমাদের সংগঠনের শ্রমিকরা মাসিক চাঁদা দেয়, সেই টাকায় অসুস্থ, দুর্ঘটনাগ্রস্ত বা মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে অনুদান দেওয়া হয়। সরকার থেকেও সহায়তা পাওয়া গেলে শ্রমিকদের জীবন কিছুটা সহজ হতো।

চুয়াডাঙ্গার লোকাল পরিবহনে কাজ করা হেলপারদের জীবনও চালকদের মতোই কঠোর ও ক্লান্তিকর। শান্ত নামের এক হেলপার রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে জানান, আমরা প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত গাড়ির সঙ্গে কাজ করি। যাত্রী ওঠা-নামার, মালামাল উঠানো-নামানোর কাজ করে মাস শেষে মাত্র ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা পাই। এতে সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব। খাদ্য ও বিশ্রাম ঠিকমতো হয় না। অনেক সময় বাসা থেকে খাবার নিয়ে রাস্তার ধারে খেতে হয়। ঘুমও ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার বেশি হয় না। দীর্ঘ সময় গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, হাতে-পায়ে ব্যথা হয়, চোখে সমস্যা হয়। রাস্তায় অবৈধ যান ও যানজটের কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে। স্বাস্থ্যঝুঁকি, শারীরিক ক্লান্তি আর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে প্রতিদিন কাজ চালাতে হয়। পরিবারকে সময় দেওয়া প্রায় অসম্ভব, সংসার চালাতে ধার নিতে হয়।
আব্দুল মজিদ নামের আরেক বাসের হেলপার রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, আমাদের পেশা অত্যন্ত কঠোর, কিন্তু সামাজিক মর্যাদা নেই। মালিক বা সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে সহায়তা খুবই সীমিত। দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার সময় নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়। তবুও আমরা এ পেশা চালিয়ে যাই, কারণ এটিই আমাদের একমাত্র জীবিকার ভরসা। কখনো গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে আমাদেরকেই প্রাথমিকভাবে মেরামত করতে হয়।
স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা পরিবার ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. মো. আওলিয়ার রহমান রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানো ড্রাইভারদের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে। এতে রক্তচাপ, স্ট্রোক ও মানসিক সমস্যা হতে পারে। দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো ঠিক নয়, এটি শুধু চালকদের নয়, যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

চুয়াডাঙ্গা বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) লিটন বিশ্বাস রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আহতদের জন্য ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয়। দুর্ঘটনায় নিহত বা আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কারো মৃত্যু হলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ এককালীন ৫ লাখ টাকা। দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানি হলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে ৩ লাখ টাকা। গুরুতর আহত এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা না থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে ৩ লাখ টাকা। গুরুতর আহত এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে অন্যূন ১ লাখ টাকা।
চুয়াডাঙ্গা ট্রাফিক পুলিশের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম রেডিও চুয়াডাঙ্গাকে বলেন, সড়কে অবৈধ যানবাহনের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। আমরা নিয়মিত চেকপোস্টে তাদের আটকে জরিমানা ও সচেতনতা কার্যক্রম চালাই। কোনো পরিবহন চালক বা শ্রমিককে হয়রানি করা হয় না।
এএইচ
অর্ণব আহমেদ আশিক 























