তিন সন্তানের জননী সংগ্রামী মা সুফিয়া বেগম। ‘বিয়ের দুই বছর পর থেকে স্বামীর সংসারে আর্থিক যোগান দিতে কুটিরশিল্পের কাজ শুরু করেন। বিয়ের চার বছর পর আমার কোলজুড়ে আসে প্রথম পুত্র সন্তান। ছেলে হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। নিজের শখ-আহ্লাদ ভুলে গিয়ে সন্তানদের মানুষ করতে অন্যের বাসাবাড়িতেও কাজ করেছি, কষ্টকে কষ্ট মনে করিনি।’
Thank you for reading this post, don't forget to subscribe!কথাগুলো বলছিলেন তিন সন্তানের জননী সংগ্রামী মা সুফিয়া বেগম। তিনি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের পাছ বারাইল গ্রামের মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী।
সুফিয়া বেগম বলেন, স্বামী, তিন সন্তান নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসারের খরচ বাড়তে থাকে। অভার-অনটনের সংসারে চাহিদা পূরণে স্বামীর পাশাপাশি বাধ্য হয়েই কাজের সন্ধানে নামতে হয়েছিল আমাকে। সংসার জীবনে প্রায় ৩৮ বছরের সংগ্রাম করে এখন আমি বড্ড ক্লান্ত। একে একে তিনটি ছেলে সন্তান হয় আমার। তিন সন্তানের লেখাপড়া আর ভরণপোষণের খরচ অনেক বেড়ে যায়। আমার স্বামী চালের কারবার করতেন। তবে হঠাৎ সেই ব্যবসায় লোকসান হওয়ার পর থেকেই সংসারে নেমে আসে অভাব-অনটন। আর্থিক দৈন্যতার কারণে ছেলেদের কখনো ভালো খাবার, পোশাকও দিতে পারিনি। কোনো রকমের ডাল-ভাত খেয়ে দিন পার করেছি। অনেক দুঃখ-কষ্টে তিন ছেলেকেই লেখাপড়া করিয়েছি।
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বসতবাড়ির ওঠান ঝাড়ু দিচ্ছেন সুফিয়া বেগম। তার স্বামী বাড়ির পাশেই ভুট্টা ক্ষেতে নিড়ানির কাজ করছেন। চারচালা টিনের একটি ঘর রয়েছে, তাও কিছুটা জরাজীর্ণ। বাড়ির এক কোণে রয়েছে গবাদিপশু রাখার জন্য একটি টিনের ছাপড়া ঘর, ভাঙাচোরা একটি রান্নার ঘর। একটি গরু আর দুটি ছাগলসহ কয়েকটি মুরগিও লালন-পালন করেন তিনি। স্বামী-স্ত্রী দুজনই বয়সের ভারে এখন আর ভারি কাজ করতে পারেন না। তাই সামান্য একটু কৃষি জমিতে ভুট্টার আবাদ আর গরু-ছাগল, মুরগি লালন-পালন করেই দিন চলে যায় তাদের। জীবনের শেষ সময়ে এসেও অভাব-অনটন পিছু ছাড়েনি সুফিয়ার সংসারে। অথচ আর্থিক দৈন্যতার সংসারেও কোথায় যেন সুখ নিহিত রয়েছে সংগ্রামী এই মায়ের পরিবারে।
জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার নবগ্রাম ইউনিয়নের মৃত জীগির আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে একই উপজেলার পুটাইল ইউনিয়নের লেমুবাড়ি গ্রামের মৃত মোহাম্মদ হাসমত আলীর ওরফে হাইছার মেয়ে সুফিয়া বেগমের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের চার বছর পর তাদের কোলজুড়ে আসে প্রথম পুত্র সন্তান। একে একে সুফিয়ার ঘরে তিন পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। বড় ছেলে নাম সোহেল হোসেন, মেজো ছেলে মাসুদ রানা আর ছোট ছেলের নাম সাজিদ হোসাইন জিসান। বড় ছেলে লেখাপাড় শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। অভাবের কারণে মেজো ছেলে ডিপ্লোমা (ইলেক্ট্রনিক) শেষ করতে পারেননি। তিনি এখন বাড়িতে বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ করে আর ছোট ছেলে মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজে গণিত বিভাগে (স্নাতক) অধ্যায়নরত আছেন।

স্বামীর সঙ্গে সুফিয়া বেগম
সংগ্রামী মা সুফিয়া বেগম বলেন, লেখাপড়ায় ভালো থাকলেও বাবার সংসারে অভাবের কারণে আমার লেখাপড়া করা হয়নি। তাই নিজের তিন ছেলেকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করার জন্য কষ্টকে কষ্ট মনে করিনি। স্বামীর চালের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার পর তিনি রিকশা চালিয়ে আর দিনমুজুরের কাজ করে যা রোজগার করতেন তা দিয়ে সংসারের খরচ মেটানো সম্ভব হতো না। তখন আমাদের বাড়ির পাশে কানিজ ফাতেমা স্কুলে একটি কাজের ব্যবস্থা করে দেন আমার স্বামী।
সংগ্রামী এই মা বলেন, সন্তানদের লেখাপাড়া করাতে গিয়ে স্বামীর সামান্য জমিটুকু বিক্রি করেছি। স্বামীর পৈতৃকভাবে পাওয়া তিন শতকের বসতবাড়িও অবশেষে বিক্রি করেছি। সব হারিয়েও ছেলেদের লেখাপড়া বন্ধ করিনি। বসতবাড়ি বিক্রি করে অবশেষে ২০১৫ সালের দিকে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে মানিকগঞ্জ শহরে যাই। সেখানে একটি বাসাবাড়িতে চার হাজার টাকা বেতেন আমি কাজ নিই, আর আমার স্বামী একটি দোকানে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বেতনে চাকরি নেন। শহরে তিন হাজার টাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। অনেক কষ্ট করেছি, দিনগুলোর কথা মনে পরলে বুকটা কেঁপে ওঠে।
তিনি বলেন, এতো কষ্ট করেছি তবুও অন্যের কাছে হাত পাতিনি। গ্রামের কোনো লোকজনের কাছ থেকে দুই পয়সাও সাহায্য সহযোগিতা পাইনি। নিজের কষ্টকে শক্তিতে রূপান্তর করেছি। গ্রামের লোকজন কত কইছে- ‘পোলাগো এতো পড়াইয়া কী হইবো, কামে দেও গা, তাইলেই তো সংসারে অভাব থাকবো না।’ কিন্তু তাদের কথা আমি উপেক্ষা করে সন্তানদের পড়াইছি। অনেকে কত চেষ্টা করছে, যাতে আমার ছেলেরা লেখাপড়া করতে না পারে। আমার ছেলেরা অন্যের মতো নয়, ওরা আমার কথায় লেখাপড়া করেছে।
স্মৃতিচারণ করে সুফিয়া বেগম বলেন, আমাদের বাড়ির পাশেই একটি খাল আছে। আমার বড় ছেলে সোহেল তখন ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। একদিন সকালে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় ওই খালের ওপর দেওয়া বাঁশের ব্রিজ ভেঙে নিচে পানিতে পড়ে গেছিল। নদীর পাড়ের একজন প্রতিবেশী এসে বলতাছে, ‘তুমার পোলা তো শেষ খালের বাঁশের ব্রিজ থেকে পইড়া পানিতে ভাসতাছে।’ তখন ছেলেকে আশপাশের লোকজন পানি থেকে ওঠায় নিয়া আসে। ছেলেকে নিয়া যে হাসপাতালে যামু সেই টাকাও ছিল না আমার। পরে পাশের দুইজন প্রতিবেশীর কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার করি, তখন আমার ছোট ভাসুর ছেলেকে নিয়া মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। সকাল ৭টার সময় ভর্তি করি আর বিকেল ৫টার সময় ছেলের জ্ঞান ফেরে। ডাক্তার কইলো এখন আপনার ছেলে কিছুটা সুস্থ।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত আমি আর আমার স্বামী না খাওয়া, অথচ আমার বাড়িতে হাঁড়ি ভরা ভাত ছিল। আমার শরিক, প্রতিবেশীসহ গ্রামের কেউ আমাগো জন্য ভাত নিয়া হাসপাতালে যায় নাই। ওই দিন আমি খুব কষ্ট পাইছিলাম। এখনো কষ্ট করছি, বড় ছেলেকে বিয়ে করাইছি। বড় ছেলে সাংবাদিকের কাজ করে যা কামাই করে তা দিয়েই সংসার চলে। আমার স্বামী-স্ত্রী তো এখন আর রোজগার করতে পারি না। ছেলের সংসার হইছে, আল্লাহ একটা নাতি দিছে। বউ-ছেলেকে কিছু দেয় আর আমাগো কিছু খরচ দেয় তাই দিয়াই চলি। মাছ, মাংস তেমন খাইতে পারি না, এখনো ডাল-ভাতই বেশি জুটে। ছোট ছেলেটা এখনো লেখাপড়া করতাছে, কেউ যদি আমাকে একটু সহায়তা করতো তাহলে আমি বাঁইচা যাইতাম, আমার একটু হলেও সুবিধা হইতো। তারপরও আল্লাহ আমাকে অনেক সুখে রাখছে, ছেলের সফলতায় আমার স্বপ্নগুলো পূরণ হচ্ছে। এতেই আমি খুশি।
প্রতিবেশী পারভীন আক্তার বলেন, উনি (সুফিয়া বেগম) আমার ম্যাডাম, আমার আরবি শিক্ষার ম্যাডাম। উনার কাছ থেকে আমি আরবি পড়া শিখছি। ছোটবেলা থেকেই দেখছি, সুফিয়া ম্যাডাম কত কষ্ট করে তার তিনটা ছেলেকে লেখাপড়া করায়ছে, মানুষ করছে। উনি জীবনকে জীবন আর কষ্টকে কষ্ট মনে করেন নাই। কখনো খেয়েও দিন পার করেছেন, আর না খেয়েও দিন পার করেছেন। কিন্তু হাল ছাড়েন নাই, শত কষ্টের মধ্যে ছেলেদের লেখাপড়া করাইছেন। হয়তো তার ছেলেরা সরকারি বড় অফিসার হতে পারে নাই, কিন্তু মানুষের মতো মানুষ হইছে। তার ছোট ছেলেটাকে এখন লেখাপাড় করাইতাছে, এখনও তিনি সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তার তিনটি ছেলে এমনভাবে মানুষ করছেন যা আমাদের গ্রামের গর্ব, আমরা গর্ব করি।
বর্তমানে স্বামী মোহাম্মদ আলী, মেজো ছেলে মাসুদকে নিয়ে সুফিয়া বেগম স্বামীর গ্রামের বাড়ি পাছ বারইলে থাকেন। লেখাপড়ার জন্য তার ছোট ছেলে সাজিদ হোসাইন জিসান জেলা শহরের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। আর বড় ছেলে সোহেল হোসেন সাংবাদিকতা পেশায় রয়েছেন।
এএইচ